আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
শুক্রবার ভোরে কয়েক ডজন সামরিক এবং ইরানের পরমাণু স্থাপনায় প্রাথমিকভাবে হামলা চালিয়েছে কয়েকশ’ ইসরাইলি বিমান।
প্রাথমিকভাবে জানাগেছে ইসরাইলি হামলায় ছয় পরমাণু বিজ্ঞানী ও ইরানি সেনা প্রধান এবং ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন নারী- শিশুসহ কমপক্ষে ৫০ জন। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ইসরাইলি হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হয়েছেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি সেনাপ্রধানের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা এবং ইসরাইলের হামলায় নিহত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ নেতা।
এদিকে তেহরানে ইসরাইলি হামলায় ‘আইআরজিসির’ প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন। ইসরাইলি হামলায় শহরে বিপ্লবী গার্ডের সদর দপ্তর আঘাত হেনেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, তেহরানের পূর্বে পিরুজি স্ট্রিটে অবস্থিত আইআরজিসি জেনারেল কমান্ড সদর দপ্তরে আগুন এবং ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।
তেহরান থেকে এএফপি এ খবর জানায়।
এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলি হামলায় দুই পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত এবং নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছেন।
অপরদিকে, ইরানের তেল মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলের মারাত্মক হামলায় মূল তেল শোধনাগার এবং জ্বালানি ডিপোগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি এবং এসব ডিপোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘দেশের পরিশোধনাগার এবং তেল ডিপোগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি এবং বর্তমানে দেশের সমস্ত অংশে এই স্থাপনাগুলোর কার্যক্রম এবং জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিকভাবে চলছে।’
শুক্রবার সকালে দেশটির শক্তিশালী বিপ্লবী গার্ড প্রধান হোসেইন সালামির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।
ইসরাইলের আইডিএফের মতে, ইরানের কাছে পর্যাপ্ত ইউরেনিয়াম রয়েছে যা কয়েক দিনের মধ্যে ১৫টি পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট।
ইসরাইলের ওপর সম্ভাব্য ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা আক্রমণের আশঙ্কায় জনগণকে প্রস্তুত থাকার জন্য সতর্কতামূলক সাইরেন বাজানো হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ইসরাইলজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে।
ইসরাইল বলেছে, ইরান এখনো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেনি, তবে তাদের কাছে হাজার হাজার এসব ক্ষেপণাস্ত্র আছে।
আইডিএফ নিশ্চিত করেছে, ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখাই এই হামলার মূল কারণ।
সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ‘ইরানি সরকারের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইসরাইল রাষ্ট্র এবং বৃহত্তর বিশ্বের জন্য একটি অস্তিত্বগত হুমকি।’
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে, ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস এবং অন্যান্য প্রক্সিদের সাথে ইসরাইল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। যার মধ্যে মিশর এবং জর্ডানসহ সমস্ত সীমান্ত দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
ইরানের ওপর ইসরাইলের আগাম হামলার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে, আইডিএফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডিফ্রিন উল্লেখ করেছেন, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্রে দু’বার আক্রমণ করেছে। এপ্রিল ২০২৪ এবং অক্টোবর ২০২৪ সালে।
তিনি আরো বলেছেন, ইরান ছিল প্রক্সিদের একটি দলের নেতা যারা যুদ্ধের সময় ইসরাইলের বিরুদ্ধে সমস্ত আক্রমণ চালিয়েছিল। যার মধ্যে ৭ অক্টোবর, ২০২৩-এ হামাসের বিশাল আক্রমণ এবং ২০২৩-এর অক্টোবর – নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত হিজবুল্লাহ ইসরাইলের ওপর হাজার হাজার আক্রমণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আইডিএফ লক্ষ্যবস্তুতে কমান্ডার, ঘাঁটি এবং পরমাণু স্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যদিও মূল লক্ষ্য পরমাণু স্থাপনা।
আইডিএফ আরো জানিয়েছে, শেষ ২০ মিনিটে ইরান অবাক হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের এমন জায়গায় আক্রমণ করা হয়েছিল যা তারা আশা করেনি।
ইসরাইলের সাথে আমেরিকার দৃঢ় সমন্বয় রয়েছে কিন্তু ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তারা বর্তমান আক্রমণের বিষয়ে আমেরিকা আগে থেকেই অবহিত ছিল নাকি সম্পূর্ণরূপে সমন্বিত ছিল তা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এদিকে রাজনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকেও আশানুরুপ সাফল্য না আসায় হামলার নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত থাকতে পারে। ‘ওয়াশিংটন টাইমস’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা এসব স্বীকার করেছেন।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বরাবরই বলে আসছেন, ‘চুক্তি হোক বা না হোক’ ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরন কর্মসূচী কখনো বন্ধ করবে না।
ইয়েমেন এবং ইরান অঞ্চলে ইসরাইলর নৌবাহিনী থাকার ফলে সামরিক প্রভাব পড়তে পারে এমন সম্ভাবনাও ছিল, যদিও আইডিএফ বিষয়টি পুরোপুরি খোলাসা করেনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলার পর মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আজ রাতে, ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত নই এবং আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এই অঞ্চলে আমেরিকান বাহিনীকে রক্ষা করা।’
তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং প্রশাসন আমাদের বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য এবং আমাদের আঞ্চলিক অংশীদারদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিয়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ইরানের মার্কিন স্বার্থ বা কর্মীদের টার্গেট করা উচিত নয়।’
ইরানের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী হামলা:
২০২৪ সালের ১৩-১৪ এপ্রিল ইরান মধ্যপ্রাচ্যকে চিরতরে বদলে দেয় ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ১৭০টি ড্রোন এবং কয়েক ডজন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে প্রকাশ্যে এবং সরাসরি ইসরাইলে আক্রমণ করে। ইসরাইলের সাথে কয়েক দশক ধরে চলা গোপন ছায়া যুদ্ধের অবসান ঘটায়।
২০২৪ সালের ১৯ এপ্রিল ইসরাইল ইসফাহানে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পরমাণু স্থাপনা রক্ষাকারী একটি এস-৩০০ বিমান বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়।
ইহুদি রাষ্ট্রটি ২০২৪ সালের অক্টোবরের মতো ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করার কথা গুরুত্বের সাথে কখনো ভাবেনি। তবে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রথম সরাসরি আলোচনা আরো নাটকীয় ফলোআপ এবং শুক্রবার সকালে পূর্বনির্ধারিত হামলার জন্য মঞ্চস্থ করে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে তেহরান সরাসরি দ্বিতীয়বার ইসরাইলে আক্রমণ করার পর একই রকম কিন্তু বিকশিত বিতর্ক শুরু হয়। এবার ১ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে ২শ’ টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর, ইসরাইল ইরানের কয়েক ডজন লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ শুরু করে। যার মধ্যে ছিল তার অবশিষ্ট সমস্ত এস-৩০০ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতার বেশিরভাগ অংশ এবং পারচিনে একটি ছোট পরমাণু স্থাপনা।