গাজায় শিশুদের চরম অপুষ্টি, আলোচনায় বসছে তিন ইউরোপীয় শক্তি

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বাড়ছে বলে বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের তিনটি দেশ – ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি – মানবিক সংকট মোকাবেলায় শুক্রবার এক ‘জরুরি বৈঠকে’ বসছে।
গাজা থেকে এএফপি জানায়, আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংস্থা ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’ (এমএসএফ) জানিয়েছে, গত সপ্তাহে তাদের ক্লিনিকে পরীক্ষা করা ছোট শিশু ও গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের অন্তত এক-চতুর্থাংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন। এর আগের দিন জাতিসংঘ জানায়, গাজা শহরের প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিতে আক্রান্ত।
এ পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি একটি জরুরি বৈঠকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পথে পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার বলেন, ‘আমি আগামীকাল ই৩ অংশীদারদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করব, যেখানে আমরা আলোচনা করব কীভাবে দ্রুত হত্যাকাণ্ড থামানো যায় এবং মরিয়া মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া যায়। পাশাপাশি একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কী কী পদক্ষেপ প্রয়োজন, তাও নির্ধারণ করব।’
তবে এই বৈঠকের ঠিক আগের দিন, কাতারে হামাসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরোক্ষ আলোচনাগুলো থেকে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র সরে আসে, ফলে গাজায় সম্ভাব্য একটি নতুন যুদ্ধবিরতির আশাও ফিকে হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের দূত স্টিভ উইটকফ হামাসকে ‘সৎ আচরণে ব্যর্থ’ বলে অভিযুক্ত করেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বৃহস্পতিবার ঘোষণা দেন, সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। এতে ইসরাইলের কড়া প্রতিক্রিয়া আসে।
এ সপ্তাহে ১০০-র বেশি ত্রাণ ও মানবাধিকার সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, গাজায় ‘ব্যাপক বুভুক্ষা’ ছড়িয়ে পড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই সংকটকে ‘মানবসৃষ্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তবে ইসরাইল দায় অস্বীকার করেছে।
ইসরাইল মার্চ মাসে গাজায় ত্রাণ অবরোধ আরোপ করে, যা আংশিকভাবে দুই মাস পরে শিথিল করা হয়।
এরপর থেকে যে সামান্য ত্রাণ প্রবাহ চলছে, তা নিয়ন্ত্রণ করছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ), যা আগের জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থার স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা জিএইচএফ-এর সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং তাদের ইসরাইলি সামরিক উদ্দেশ্যে সহায়তা করার অভিযোগ তুলেছে।
এই ব্যবস্থায় গাজার মানুষদের দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে চারটি নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে হয়, যা অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, মে মাসের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত এসব জিএইচএফ কেন্দ্রের আশপাশে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে ৭৫০-এর বেশি ফিলিস্তিনি ত্রাণপ্রার্থী নিহত হয়েছেন।
একজন এএফপি ফটোগ্রাফার বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনুসের নাসের হাসপাতালে আহত ও রক্তাক্ত ত্রাণপ্রার্থীদের মেঝেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ইসরাইল জাতিসংঘের পুরোনো ত্রাণ ব্যবস্থায় ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছে, সেটির মাধ্যমে হামাস ত্রাণ দখল করতো।
‘খাদ্যকে অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ তুলে এমএসএফ জানিয়েছে, ‘গত সপ্তাহে তাদের সেবাকেন্দ্রে ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের স্ক্রিনিংয়ে দেখা গেছে, তাদের ২৫ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন।’
এমএসএফ আরও জানায়, ১৮ মে-র পর থেকে গাজা শহরের তাদের ক্লিনিকে অপুষ্টির হার চার গুণ বেড়েছে এবং প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে।
ত্রাণ সংস্থা ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খাবারের অভাবে অনেক রোগী সুস্থ হতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানায়, গাজা শহরের প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিতে আক্রান্ত।
সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, ‘আমাদের টিমের সামনে যেসব শিশুরা আসছে, তারা রুগ্ন, দুর্বল এবং দ্রুত চিকিৎসা না পেলে তাদের মৃত্যু হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউএনআরডব্লিউএ-র ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীরা দিনে মাত্র একটি ছোট মিল খাচ্ছেন, অনেক সময় শুধু ডাল, কখনো তা-ও না।’
লাজারিনি জানান, সংস্থাটির হাতে ৬,০০০টি লোডেড ট্রাকের সমপরিমাণ খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী প্রস্তুত রয়েছে, যা ইসরাইল ‘অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার’ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে গাজায় পাঠানো সম্ভব।
হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলের সামরিক অভিযানে ৫৯,৫৮৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলায় যুদ্ধ শুরু হয়। এএফপি’র সংকলিত সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সে হামলায় ১,২১৯ জন ইসরাইলি নাগরিক নিহত হন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
সে সময় নেওয়া ২৫১ জন জিম্মির মধ্যে এখনো ৪৯ জন গাজায় আটক রয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৭ জন মারা গেছেন বলে দাবি করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *