শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশির ভাগের মাথার খুলি ছিল না। গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো: মাহফুজুর রহমান তার জবানবন্দীতে এ কথাগুলো বলেন।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় ১৩তম সাক্ষী হিসেবে মাহফুজুর রহমান এই জবানবন্দী দেন। শেখ হাসিনা ছাড়া এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
সাবেক আইজিপি মামুন ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি তিনি এ মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হয়েছেন। গতকাল তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
জবানবন্দীতে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলি ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সঙ্কুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশির ভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ২৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়।’
গণ-অভ্যত্থানে আহতদের প্রায় ৩৩টি অস্ত্রোপচার নিজে করেছেন বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো বুলেট ও পিলেট আহত আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করেছি। অনেকগুলো গুলি ও পিলেট রোগীরা চেয়ে নিয়ে যায়। তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ তালিকামূলে দু’টি পিলেট এবং একটি বড় বুলেট ও আরো একটি গোলাকার বুলেট জব্দ করেছে।’
জবানবন্দীতে মাহফুজুর রহমান বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই যখন রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল, তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য তাকে চাপ দেন।
মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘(ডিবি) বলে, আপনি অতি উৎসাহী হবেন না, আপনি বিপদে পড়বেন। তারা আরো বলে, যাদের ভর্তি করেছেন, তাদের রিলিজ করবেন না- এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্টারে রোগীদের জখমের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি।’
জবানবন্দীতে মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, উপরিউক্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। তার নির্দেশ কার্যকরকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এবং যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করেছেন, তাদের বিচার ও ফাঁসি চান তিনি।
এই জবানবন্দী গ্রহণের পর পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন ১০ মিনিট বিরতি দিয়ে সাক্ষীকে জেরা করেন। তিনি সাক্ষীকে বলেন, আপনি আপনার জবানবন্দীতে বলেছেন ইমারজেন্সি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছিল। তাদের নাম আপনি বলতে পারবেন? জবাবে ডা: মাহফুজুর রহমান বলেন আমার টিমে ১৩-১৪ জন ডাক্তার ছিলেন। তখন আমাদের ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক ডা: কাজী দ্বীন মোহাম্মদ।
আইনজীবী তখন বলেন, আপনারা আন্দোলনের শুরুতেই চিকিৎসার জন্য টিম গঠন করেছিলেন। অর্থাৎ আগে থেকেই জানতেন এই আন্দোলনের পরিণতি সম্পর্কে। জবাবে সাক্ষী বলেন, নাহ, আমরা জানতাম না। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে অনুমান করেছিলাম। আরো আহত রোগী হাসপাতালে আসতে পারে। আসলে সে সময় উত্তাল আন্দোলন চলছিল বিধায় আহতদের চিকিৎসা দেয়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম।
তখন আইনজীবী বলেন, আপনি তৎকালীন সরকারের বিরোধী মতের লোক ছিলেন। এজন্য সরকার পতনের আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তখন সাক্ষী বলেন, ইহা সত্য নয় যে, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এবং সরকার পতন ঘটনার জন্য যুক্ত ছিলাম।
পরবর্তী প্রশ্নে হাসিনা ও কামালের আইনজীবী বলেন যে, ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের বেশির ভাগের মাথায় খুলি ছিল না মর্মে যে তথ্য আপনি আজ দিয়েছেন- তা তদন্তকারী কর্মকার্তাকে বলেননি। সাক্ষী তখন বলেন, ইহা সত্য। তবে আমি ১৬৩ জনের কথা তখন বলেছিলাম। পরে আরো নতুন করে চারজন ভর্তি হয়েছিল।
এদিন দ্বিতীয় সাক্ষী ছিলেন শাহনাজ পারভীন। তিনি বলেন, আমি সিনিয়র স্টাফ নার্স, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউড অব নিওরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটাল, ঢাকা। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমার সামনে আমার হাসপাতাল থেকে দু’টি পিলেট, একটি লম্বা বড় বুলেট, একটি গোল বুলেট জব্দ করেন। এই সেই জব্দ তালিকায় আমার স্বাক্ষর রয়েছে।
পুলিশের ভয়ে ইবনে সিনায় গোপনে গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা দেয়া হয় : চব্বিশের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট। ইবনে সিনা হাসপাতালে আসতে থাকে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্র-জনতা। কিন্তু তাদের সেবায় বাধা হয়ে দাঁড়ান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নজরদারি বাড়ান পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। আর এসব ভয়ে জুলাই-আগস্টে আহতদের লুকিয়ে রেখে গোপনে চিকিৎসা দেন চিকিৎসকরা। এমনকি গুলিবিদ্ধদের ভিন্ন নাম-ঠিকানায় কিংবা ভিন্ন রোগে হাসপাতালে রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এক সাক্ষীর জবানবন্দীতে উঠে এসেছে এমন তথ্য। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল গতকাল। এদিন ১৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ডা: হাসানুল বান্না। তিনি রাজধানীর কল্যাণপুর ইবনে সিনা হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়।
সাক্ষীর ডায়াসে উঠে শুরুতেই নিজের পরিচয় দেন ডা: বান্না। জবানবন্দীতে ৪৩ বছর বয়সী এই চিকিৎসক বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই এবং ২, ৩, ৪ ও ৫ আগস্টসহ পরবর্তী সময়ে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্র-সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দেই। ১৮ জুলাই দুপুরের পর থেকেই আমাদের হাসপাতালে আহতরা আসতে থাকেন। যাদের অনেকের অপারেশন করতে হয়েছে। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যার পর হাসপাতালে এসে চিকিৎসায় বাধা দেন পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আহতদের ভর্তি করতেও নিষেধ করেন তারা। একইসাথে রেজিস্টার দেখে রোগীদের তালিকা নিয়ে যান।’
এখানেই থেমে থাকেননি পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ১৯ জুলাই সকাল থেকে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ কর্মীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে চেয়ার নিয়ে সারা দিন বসে ছিলেন। তারা কোনো রোগীকে হাসপাতালে ঢুকতে দেননি। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে-বের হতেও দেয়া হয়নি। ওই দিন মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে গুলিবিদ্ধ হন ইবনে সিনা হাসপাতালের টেকনোলোজিস্ট মিতুর স্বামী মোস্তাকিন বিল্লাহ। যিনি ইনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টেকনোলোজিস্ট ছিলেন।
ডা: বান্না বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ মোস্তাকিনকে বিকল্প পথে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার জরুরি অপারেশনের প্রয়োজনে নিউরো সার্জন আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অ্যাম্বুলেন্স বের হতে দেয়নি। এরপর তাকে বিকল্প পথে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে সেখানে তার ভর্তি নেয়া হয়নি। পরে ইবনে সিনা ধানমন্ডি শাখায় নিলে চিকিৎসকরা মোস্তাকিনকে মৃত ঘোষণা করেন।’
জবানবন্দীতে এই সাক্ষী বলেন, ‘১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে আসা গুলিবিদ্ধদের ভিন্ন নামে ও ভিন্ন রোগের কথা উল্লেখ করে লুকিয়ে রেখে গোপনে চিকিৎসা দিই আমরা। মূলত পুলিশের নজরদারি এডিয়ে তাদের সাধারণ ওয়ার্ডে না রেখে পোস্ট অপারেটিভ, আইসিইউ ও বিশেষ কেবিনে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দেন ইবনে সিনা হাসপাতালের চিকিৎসকরা।’
এসব ঘটনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনকে দায়ী করেন ডা: হাসানুল বান্না। তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনার জন্য শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়ী মনে করি। আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে এ ঘটনার সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি।’
এদিন হাসানুল বান্না ছাড়াও আরো তিন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হলেন- ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, একই হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীন ও শহীদ শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাদের জেরা করেন শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।