গাজায় যুদ্ধবিরতি : যেসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন নেতানিয়াহু

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাস্তবায়ন স্থবির হয়ে পড়েছে। অবশ্য তাদের মাঝে রাজনৈতিক সংলাপ অব্যাহত রয়েছে। ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কৌশলে এড়িয়ে চলা এবং প্রতিশ্রুতিহীনতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। বিশেষ করে চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করতে তার অনীহা স্পষ্ট। তিনি প্রথম পর্যায়ের সময়সীমা বাড়ানো এবং গাজা উপত্যকায় সাহায্য ও ওষুধ সরবরাহের শর্তে বন্দীদের মুক্তির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নেতানিয়াহু যে সম্প্রসারণমূলক ধারণার ভিত্তিতে এগোচ্ছেন, তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটি তাকে মূল চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো বাস্তবায়নে বাধ্য করে না। বিশেষ করে গাজা উপত্যকা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার, আগ্রাসন বন্ধ করা এবং পুনর্গঠন শুরু করার প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে যাওয়া তার লক্ষ্য। তিনি একটি নতুন পথ তৈরির চেষ্টা করছেন, যেখানে বন্দীদের বিনিময়ে ধাপে ধাপে সাহায্য প্রদান করা হবে- যতক্ষণ না হামাসের শক্তি ও কূটনৈতিক সমর্থন সরিয়ে নেয়া হয়।
নেতানিয়াহুর জন্য বেশ কয়েকটি কারণে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে। যেমন যুদ্ধ বন্ধ ও গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত তার চরমপন্থী জোটকে দুর্বল করতে পারে, যা আগাম সংসদীয় নির্বাচনের পথ খুলে দেবে। মতামত জরিপে দেখা যাচ্ছে, তিনি সেই নির্বাচনে পরাজিত হবেন। ফলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হতে পারে। যুদ্ধপরবর্তী আনুষ্ঠানিক তদন্ত কমিশনের আওতায় নেতানিয়াহুকে ৭ অক্টোবরের নিরাপত্তা ব্যর্থতা ও গাজায় যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হতে পারে। এর ফলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে। চরম ডানপন্থী নেতারা এই চুক্তিকে ইসরাইলের জন্য ঐতিহাসিক পরাজয় হিসেবে দেখছেন। কারণ এটি গাজার যুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক ব্যর্থতাকে প্রকাশ করেছে এবং তার কৌশলগত শক্তিকে দুর্বল করেছে।
মার্কিন প্রশাসনের লক্ষ্য ও ইসরাইলের চরম ডানপন্থী সরকারের কৌশল এক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ হোক। কারণ এই যুদ্ধের ধারাবাহিকতা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে। এছাড়া বন্দীদের মুক্তি করা। বিশেষ করে মার্কিন নাগরিকদের, যা মার্কিন প্রশাসনের একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন হিসেবে দেখা হবে।
এসব কারণে মার্কিন বন্দীবিষয়ক দূত অ্যাডাম বোহলার সরাসরি হামাসের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং ইসরাইলি মন্ত্রী রন ডার্মারের আপত্তির জবাবে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমরা ইসরাইলের এজেন্ট নই।’
তবে এই মতপার্থক্য এখনো এমন স্তরে পৌঁছায়নি যেখানে ওয়াশিংটন নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নে বাধ্য করবে। বরং তিনি ওয়াশিংটনে তার সমর্থকদের একত্রিত করে ট্রাম্প প্রশাসনকে হামাসের সাথে সরাসরি সংলাপ বন্ধ করতে চাপ দিচ্ছেন।
গাজায় হামাস এক কঠিন মানবিক সঙ্কটের মুখোমুখি। অবরোধ প্রত্যাহার ও জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে তারা আলোচনার কৌশল নির্ধারণ করছে। তাদের কৌশল হলো, বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা, দখলদার বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তা প্রবেশ, চুক্তির মৌলিক শর্তগুলি পূরণ না হলে তারা কোনো আপস করবে না।

এই প্রেক্ষাপটে কিছু নতুন ধারণাও উঠে এসেছে, যেমন বন্দীদের ধাপে ধাপে মুক্তি অথবা চুক্তির শর্ত সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের পর একসাথে বন্দীদের মুক্তি।
নেতানিয়াহু চুক্তির বাস্তবায়ন এড়িয়ে চলছেন এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য বাধ্যতামূলক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না, বিশেষ করে মার্চের শেষ পর্যন্ত। এর কারণ হলো, তার সরকার টিকিয়ে রাখা ও বাজেট আইন পাস করা, যা ব্যর্থ হলে আগাম নির্বাচন অনিবার্য হবে। এটি অর্থমন্ত্রী স্মোট্রিচের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ, যিনি পুনরায় সংসদে ফিরে আসতে ব্যর্থ হতে পারেন।
নেতানিয়াহুর সকল রাজনৈতিক কৌশল তার ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ ও চরমপন্থী জোটের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। তবে ইসরাইলি জনমত তার অবস্থান সমর্থন করছে না। বরং যুদ্ধের অবসান ও বন্দীদের মুক্তি চায়।
কাতারি ও মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীরা চুক্তি বাস্তবায়নে আগ্রহী। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এখনো নেতানিয়াহুকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেনি। তবে ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী অবস্থানই এই দুষ্টচক্র ভাঙতে পারে। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প প্রশাসন কি তা করবে, নাকি নেতানিয়াহু নতুন মার্কিন প্রশাসনকে তার রাজনৈতিক জটিলতায় জড়াতে সফল হবেন?

সূত্র : আল জাজিরা নেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *