ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধে বাংলাদেশে জাতীয় সংলাপে উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ

এম এইচ হাফিজ:

সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ আজ ঢাকায় চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে মহিলার অগ্রগতি ও লিঙ্গ সমতা বিষয়ক লোকাল কনসালটেটিভ গ্রুপ এবং জাতিসংঘ যৌথভাবে ২০২৫ সালের বৈশ্বিক “১৬ ডেজ অব অ্যাক্টিভিজম এগেইনস্ট জেন্ডার-বেইজড ভায়োলেন্স”-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন।
ঢাকার বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ কনভেনশন সেন্টারে “নারী ও কন্যাদের প্রতি ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হই” স্লোগানে এ জাতীয় আহ্বান জানানো হয়।

১৮ নভেম্বর শুরু হওয়া ইউএন উইমেনের বৈশ্বিক আহ্বানের উপর ভিত্তি করে আয়োজিত এ জাতীয় সংলাপে সরকার, জাতিসংঘ, কূটনৈতিক মিশন, সিভিল সোসাইটি, তরুণ নেতৃত্ব এবং প্রযুক্তিখাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং প্রযুক্তি-নির্ভর সহিংসতা মোকাবিলার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, সাইবার জগতে অনিরাপদ নারী হয়রানির শিকার পদে পদে।
আগে একটি মেয়ে রাস্তায় বের হলে ইভ টিজিং-এর ভাবনা করত; এখন মেয়েরা সাইবার স্পেসে গেলেই সাইবার বুলিং -এর মুখোমুখি হচ্ছেন। এই সাইবার বুলিং এর জগত আরও ব্যাপক হয়েছে । এখন সাইবার স্পেজের মাধ্যমে এটি আর শুধুই কোনো প্রতিবেশীর ছেলে নয়, সারাবিশ্বের যে কেউ আপনার মর্যাদার উপর হামলা করে চালাতে পারে। প্রযুক্তি তার নিজস্ব গতিতে চলবে, কিন্তু আমরা কীভাবে মনোভাব গড়ে তুলছি সেটাই নির্ধারণ করে দেবে এর দিক। তাই ১৬ ডেজ অব অ্যাক্টিভিজম আমাদের জন্য প্রতিদিনের একটি সম্মিলিত স্মরণিকা বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫৯ শতাংশ নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছে, ভুক্তভোগী ৯০ শতাংশ নারী অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, দেশে সাইবার অপরাধ দমনে অনেক ভালো ভালো আইন রয়েছে কিন্তু এসবের প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা এ সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, সাইবার সহিংসতা রোধ শুধু কোন মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানের একার কাজ নয়। এটি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রের কাজ উল্লেখ করে বলেন, মেয়েরা কখনো কোনো নিরাপদ পরিস্থিতি অনুভূত হলে প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সহযোগিতা নিতে হবে। মন্ত্রণালয়ে কে জানাতে হবে, আমার মন্ত্রণালয়ের কুইক রেসপন্স টিম ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভিকটিম এর কাছে পৌঁছে যাবে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ এনডিসি আরও শক্তিশালী আইন, সমন্বিত প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ডঃ মোহাম্মদ আবু ইউছুফ বলেন, ডিজিটাল সহিংসতা একটি বৈশ্বিক বিষয়, যা মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, বিশ্বের ৪০ শতাংশেরও কম দেশে সাইবার হ্যারাসমেন্ট বা সাইবারস্টকিং-এর বিরুদ্ধে নারীদের সুরক্ষার আইন রয়েছে। ফলে বিশ্বের ৪৪ শতাংশ নারী ও কন্যা—মোট ১.৮ বিলিয়ন মানুষ আইনগত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। অনলাইন হয়রানি, সাইবারস্টকিং, ডিপফেক, জেন্ডারড ডিসইনফরমেশনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল অপরাধ নারীর অধিকার হুমকির মুখে ফেলছে।

অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার সুসান রাইল বলেন,
এটি শুধু নারীর সমস্যা নয়, আমাদের সবার সমস্যা। তাই সরকার, সংগঠন এবং নারীরা একসঙ্গে লড়তে হবে। একটি এমন পৃথিবী গড়তে হবে, যেখানে প্রযুক্তি ও সহযোগিতা সবার নিরাপত্তা ও সমতা নিশ্চিত করবে।

সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইক্স বলেন,
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকারদের বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। এটি অপরাধীদেরকেও বার্তা দেয় যে তাদের অপরাধ অমার্জিত থাকবে না। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন নারী, কন্যা ও ছেলেদের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইউএন উইমেন প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিংহ বলেন,
ডিজিটাল সহিংসতার কোনো সীমানা নেই। বিশ্বে ১৬ থেকে ৫৮ শতাংশ নারী ও কন্যা অনলাইন হয়রানির শিকার। অনলাইন হয়রানি এবং বুলিং প্রায়ই অফলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, নারীর কণ্ঠ স্তব্ধ করে এবং জনজীবনে অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করে। একটি ভিন্ন ভবিষ্যৎ সম্ভব—যেখানে নারী ও কন্যারা সর্বত্র নিরাপদ থাকবে।

উদ্বোধনের পর অনুষ্ঠিত হয় উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনা। “বাংলাদেশে প্রযুক্তি-নির্ভর সহিংসতা প্রতিরোধ: ঘাটতি, চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ” শীর্ষক—যা পরিচালনা করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব দিলারা বেগম।

আলোচনায় অংশ নেন:বিটিআরসির মাহমুদ হোসেন,
ইউজিসির নাসিমা আখতার ,উম্মে শরাবান তাহুরা (আইন ও ন্যায় বিভাগ),লাবণ্য বিনতে হাফিজ(ইয়ুথ পলিসি ফোরাম) প্রমুখ।
প্যানেলিস্টরা প্রমাণভিত্তিক নীতিনির্ধারণে ঘাটতি, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, নারীদের ডিজিটাল সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং অনলাইন ক্ষতির ঘটনায় রিপোর্টিং ও প্রতিক্রিয়ার জন্য সমন্বিত জাতীয় কাঠামোর অভাব তুলে ধরেন।

সমাপনী বক্তব্যে ইউএনএফপিএ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন,প্রযুক্তি-নির্ভর জিবিভি বাস্তব এবং অন্য যেকোনো জিবিভি ধরনের মতোই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আমরা আজ যেভাবে বিষয়টি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছি, এটি মাত্র একটি ছোট পদক্ষেপ। তদন্ত উন্নত করতে আইনি কাঠামো ও দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া অবশ্যই বেঁচে থাকা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া উচিত।

বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশনের ৩০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ২০২৫ সালের এই প্রচারণা সরকার, বেসরকারি খাত, সিভিল সোসাইটি, তরুণ সংগঠন ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রযুক্তিনির্ভর সহিংসতা নির্মূলে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *