মুহম্মদ তরিকুল ইসলাম, পঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় ১৯৮২ সালে পত্তনী কেস মূলে বন্দোবস্ত নেওয়া জমির উপর এসিল্যান্ডের অপসারণ নোটিশ, উপায়ন্তর না পেয়ে অসহায় গরিব ভুক্তভোগী ব্যক্তির আদালতে মামলা এসিল্যান্ডসহ তিনজনকে শোকজ, অস্থায়ী ও অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ মঞ্জুর।
উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের খুনিয়াভিটা গ্রামের ভুক্তভোগী মোমিন উদ্দীন ওরফে আব্দুল মোমিন ওরফে মংলু মোহাম্মদের ছেলে রফিক আলম, রফিকুল ইসলাম ও মেয়ে মেহেরুন নেছা বাদী হয়ে বিজ্ঞ সহকারী জজ আদালত তেঁতুলিয়া পঞ্চগড়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পক্ষে পঞ্চগড় ডেপুটি কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) তেঁতুলিয়া পঞ্চগড় কে বিবাদী করে স্বত্ব ঘোষণামূলক ডিক্রির মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং হচ্ছে ৫৭/২০২৫। পরে বাদী পক্ষে বিবাদীগণের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে অস্থায়ী ও অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রার্থনা করেন। এরপর বিজ্ঞ আদালত অন্তবর্তীকালীন আদেশ দ্বারা বাদী পক্ষের বর্ণিত তফসিলে বিবাদীগণকে বারিত করেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, উপজেলার তেঁতুলিয়া মৌজার জে.এল নং-১০ এর এস.এ ১নং খতিয়ান ভুক্ত এস.এ ২০৭২ নং দাগে মোট ৪৫শতক জমি সরকার পক্ষে কালেক্টরের নামে ১নং খতিয়ানে রেকর্ডভুক্ত হয়। পরে সরকার পক্ষে কালেক্টর ১৯৮২-১৯৮৩ সালে ১১ নং পত্তনী কেস মূলে এস.এ ২০৭২ নং দাগের ৪৫শতক জমির মধ্যে ৪০শতক জমির ব্যবহৃত শ্রেণি পরিবর্তন করে বাদীর পিতা মোমিন উদ্দীন ওরফে আব্দুল মোমিন ওরফে মংলু মোহাম্মদ বরাবরে পনেরো বছর মেয়াদে বন্দোবস্ত করে দেন। বন্দোবস্ত দেওয়ার সময় এস.এ রেকর্ড চলাকালীন সময়ে উক্ত ২০৭২ নং দাগ গোরস্থান রুপে রেকর্ডভুক্ত হয়। তবে তৎকালীন সময়ে শুধু উক্ত দাগের ৫শতক জমি গোরস্থান রুপে ব্যবহৃত হওয়ায় ৪০ শতক জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে মংলু মোহাম্মদকে পত্তনী কেসে ৩২০৮নং বন্দোবস্ত কবুলিয়ত দলিল প্রদান করা হয়। এরপর মংলু মোহাম্মদ মৃত্যু বরণ করলে তার ত্যাগত্যক্ত সম্পত্তিতে রেখে যাওয়া ওয়ারিশগণ সর্বশেষ ২০২৫-২০২৬ অর্থবছর পর্যন্ত সকল প্রকার সরকারি দাবি ও খাজনাদি পরিশোধ পূর্বক ভোগদখলে করে আসছেন। এরই মধ্যে বিবাদী সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম.এম আকাশ তেঁতুলিয়া পঞ্চগড় চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ২৩-৪৩৭নং স্মারকে উপর মহলের লিখিত কোনো নির্দেষ ছাড়াই বিনা কারণে ভুক্তভোগী বাদীগণকে ওই জমি হতে সকাল প্রকার স্থপনা সাত দিনের মধ্যে অপসারণ করার নোটিশ প্রদান করেন। অপসারণ নোটিশ পাবার পর অত্যান্ত ভয়ভীতি পেয়ে ভুক্তভোগী পরিবার উপায়ন্ত খুঁজে না পেয়ে বিজ্ঞ আদালতের স্মরণাপন্ন হোন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, মংলু মোহাম্মদ এর জীবদ্দশায় তিনি ওই জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার পর পরম শান্তিতে বসতবাড়ীসহ বিভিন্ন ফসলাদির আবাদে ভোগদখল করে আসছেন। তার মৃত্যুর পরও ত্যাগত্যক্ত ওয়ারিশগণও ভোগদখলে ছিলেন। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন খুনিয়াভিটা গ্রামের কাজী শামসুর রহামের ছেলে কাজী আমিনুর রহমান ও কাজী ফারুক সহ কয়েকজন মিলে বাদীপক্ষকে উচ্ছেদ করে দেয়। দীর্ঘদিন বাদীপক্ষ বিচারের দাবীতে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও কোথাও কোনো বিচার পাননি। পরিশেষে বাদীপক্ষ মানুষের দ্বারেদ্বারে ঘুরে বেড়ান, গাছ তলা কিংবা ভাড়াটিয়া বাসাবাড়ীতে বসবাস করে আসেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দীর্ঘ কষ্টে গড়া বন্দোবস্ত জমি পূনরায় উদ্ধার করেন বাদীপক্ষ। উদ্ধারের পর আবারো কাজী আমিনুর রহমান সহ কয়েকজন উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লাগেন। পরে বাদীপক্ষ ৯৯৯ জরুরি কল সেবায় কল করেন। জরুরি কল সেবায় কল করেও কোনো ফলাফল না পেয়ে বিচারের দাবিতে ছুটে যান উপজেলা ভূমি অফিস। উপজেলা ভূমি অফিসে বিচারের আশ^াসে ছুটে গেলেও উল্টো অপসারণ নোটিশ করেন এসিল্যান্ড।
এদিকে বিজ্ঞ আদালতের কারণ দর্শানোর জবাবে সহকারী কমিশনারের নির্দেশক্রমে ইউনিয়ণ ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ওমর ফারুক চলতি বছরের বিগত ২১ অক্টোবর ১৭২ নং স্মারকে কারণ দর্শানোর জবাবে বলেন, বাদীপক্ষের পিতা মংলু মোহাম্মদের নামে বন্দোবস্ত ছিল, জমির শ্রেণি কবরস্থান থানায় দখল দেওয়া হয়নি। প্রশ্ন উঠে দখল ছাড়াই বন্দোবস্ত হয় কিভাবে? তিনি তার কারণ দর্শানোর জবাবে আরও বলেন খুনিয়াভিটা, মোমিনপাড়া ও তেলিপাড়া গ্রামের প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি বন্দোবস্তকৃত জমিটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু প্রতিবেদকের অনুসন্ধান বলছে, তিন গ্রামের ৮ থেকে ১০ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি তো দুরের কথা বরং একমাত্র খুনিয়াভিটা গ্রামের ২০ থেকে ২৫টি বাড়ীই ওই আংশিক কবরস্থান ব্যবহার করে আসছে এবং দৃশ্যমান কয়েকটি কবরও রয়েছে। কারণ দর্শানোর জবাবে আরও বলা হয় বাদীপক্ষের নালিশী দাগের জমি কবরস্থান হওয়ায় কখনো বন্দোবস্ত গ্রহীতার দখলে ছিলনা বা বর্তমানেও নাই। এ থেকে প্রতিবেদক স্পষ্ট হয় যে, যেহেতু বাদীপক্ষ বর্তমানে বন্দোবস্ত জমির দাগে বসতবাড়ী করে অবস্থান করছেন সেহেতু আংশিক দৃশ্যমান কবরস্থানকৃত জমিতে বাদীপক্ষ দখলে ছিলনা।
অপরদিকে বিজ্ঞ আদালতের কারণ দর্শানোর জবাবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) তেঁতুলিয়া এস.এম আকাশ চলতি বছরের বিগত ২১ অক্টোবর ২৩-৪৮৮ নং স্মারকে কারণ দর্শানোর জবাবে বলেন, ১৯৯২-১৯৯৩ সালে মিস কেসের মাধ্যমে বন্দোবস্ত বাতিলের আদেশ হওয়া এবং সরকারি স্বার্থ জড়িত থাকায় এছাড়া ষাট বছরের অধিক সময় স্থানীয় প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। সহকারী কমিশনারের এই কারণ দর্শানোর জবাবে প্রতিবেদক বলছেন, যেখানে ওই গ্রামের মাত্র গুটি ২০ থেকে ২৫টি বাড়ী রয়েছে অতএব প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান ওই কবরস্থান ব্যবহারের প্রশ্নই আসেনা। ১৯৮২-১৯৮৩ সালের বন্দোবস্ত জমি ১৯৯২-১৯৯৩ সালে বাতিল হলেও ৩৩ বছর পর কেন এই জল্পনা-কল্পনা? ১৯৮২-১৯৮৩ সালের বন্দোবস্ত জমি ১৯৯২-১৯৯৩ সালে বাতিল হয়েছে কিনা প্রতিবেদক জেলা পর্যায় খোঁজ নিতে গেলে কোনো তথ্য উপাত্ত খুঁজে পাননি।
স্থানীয় খুনিয়াভিটা গ্রামের ব্যক্তি কছিম উদ্দিন তিনি জানেন ২৫/৩০টি বাড়ি খুনিয়াভিটা গ্রামে রয়েছে এর মধ্যে কেউ মারা গেলে এই গোরস্থানে দাফন করা হয়। বাকি যেসব পাড়া রয়েছে তা কেন্দ্রীয় গোরস্থানে দাফন করা হয়। খুনিয়াভিটা গ্রামের আরেক স্থানীয় ব্যক্তি আব্দুল রহিম বলেন, তাদের খুনিয়াভিটা গ্রামের মানুষজন মারা গেলেই কেবল খুনিয়াভিটা গ্রামের কবরস্থানে দাফন করেন। তেলিপাড়া মোমিনপাড়া গ্রামের কেউ মারা গেলে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মামলা বাদী রফিক আলম বলেন, তারা মামলার নালিশী জমি পত্তন নিয়েছেন। পত্তন নেওয়ার পর অনেকদিন ভোগদখল করে বাড়ী তুলেন। ভোগদখলে অবস্থান করাকালীন কাজীরা(আমিনুর রহমানগংরা) আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষাতায় থাকাকালীন সময় বাড়ীঘর ভেঙে উচ্ছেদ করে দেয়। পড়ে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়ার পর আওয়ামীলীগ ক্ষমতা যাওয়ার পর আবার তাদের পত্তনকৃত জমি দখলে নেন। দখল নেওয়ার পর কাজীরা আবারো বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিয়ে আসছেন। এসিল্যান্ডের কাছে গেলে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদের নোটিশ করেন। পরে তারা এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে মামলা করেন।
কাজী আমিনুর রহমান ও কাজী ফারুকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, তাদের কেউ কোনদিন বাদীর বাড়িতে মারামারি করতে যায়নি। ইতোপূর্বে তাদের কেউ উচ্ছেদ করতে যায়নি। বাদীপক্ষ জরুরি কল সেবায় ফোন দিলেন কেন এবং পুলিশ আসলেন কেন প্রশ্নোত্তরে আমিনুর রহমান বলেন, তারা (বাদীপক্ষরা) যে জমি দখল করছেন তার চারপাশে যে গাছপালা রয়েছে তিনি লাগিছেন। গাছপালা রক্ষার্থে তিনি সেখানে যান।
এ বিষয়ে জানতে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ওমর ফারুকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করলে মুঠোফোন কথা বলতে চায়নি। তিনি দায়িত্ব থাকাকালীন তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাইতে বলেন। কিন্তু দু’দিন অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস.এম আকাশ বলেন, নির্দেশনা মোতাবেক অপসারণ নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে। কেননা সেখানে সরকারের স্বার্থ জড়িত আছে এবং বন্দোবস্তটি বাতিল হয়েছে। বন্দোবস্তকৃত জমির শ্রেণি ছিল কবরস্থান। এতো আগের বাতিল এখন কেন উত্থাপন হচ্ছে এমন প্রশ্নে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। আগের নথি এখন পাওয়া যাবেন এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, নথি ধ্বংস করার বিধান আছে হয়তো নাও থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, এসিল্যান্ড অপসারণ নোটিশ করছেন কিনা তিনি এ বিষয়ে অবগত নন এবং নোটিশের প্রেক্ষিতে আদালতে মামলা হয়েছে কিনা এসিল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলবেন জানান তিনি।