মতিউরের দুই স্ত্রী ছাড়াও আছে বান্ধবী তিনিও কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মূসক মনিটরিং, পরিসংখ্যান ও সমন্বয় বিভাগের দ্বিতীয় সচিব হিসেবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত থাকাকালে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন আরজিনা খাতুন। এ সব অর্থ দিয়ে তিনি ঢাকা ও নিজ জেলা রাজবাড়ীতে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এমন অভিযোগ দায়ের করেছেন ফেয়ার অ্যান্ড সন্স কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে মো. ইসতিয়াক আহমেদ রেজা নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগটি এখন অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে।

এদিকে, ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে যাওয়া এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে আরজিনা খাতুনের সখ্যতা ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।

দুদকে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আমদানি পণ্য খালাসের নামে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছ থেকে আরজিনা খাতুন মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। অনেক সময় পণ্য খালাসের কাজ না হলেও ফেরত দিতেন না ঘুষের টাকা। এভাবে দুর্নীতির টাকায় তিনি গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। একইসঙ্গে তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারীদের সঙ্গে যোগসাজসে হাতিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি টাকার স্বর্ণ।

অভিযুক্ত আরজিনা খাতুন আগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার ছিলেন। এক বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে এনবিআরে বদলি করা হয় তাকে। চট্টগ্রামে থাকাকালে তার ঘুষের টাকা লেনদেনের বাহক ছিলেন তার বন্ধু আবু তাহের, অফিসের পিয়ন মো. ইলিয়াস ও গাড়িচালক শাহাজাহান আকতার।

রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার তালুকপাড়ার গ্রামের আহমেদ আলীর মেয়ে আরজিনা খাতুন। তার বিরুদ্ধেদুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থে ৫০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন আরজিনা খাতুন। তিনি বার্ষিক আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন, বিয়ের সময় ১০০ ভরি স্বর্ণ উপহার পেয়েছেন। তবে তার কাবিননামায় এসব স্বর্ণের কথা উল্লেখ নেই।

অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা ১০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন ঢাকার রয়েল মালাবার থেকে। বাকি ৩০০ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন ঢাকার আপন জুয়েলার্স ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড থেকে। বর্তমানে এসব স্বর্ণের মূল্য অন্তত ৬ কোটি টাকা। দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লকারে ও দোকানে স্বর্ণগুলো বন্ধক রেখেছেন তিনি।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কেনা মূল্য গোপন করে ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন আরজিনা খাতুন। ফ্ল্যাটটি কিনেছেন ২ কোটি টাকায়। তবে কেনার চুক্তিনামায় উল্লেখ করেছেন ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ ছাড়া ফ্ল্যাট কেনার পর সেখানে ইনটেরিয়র ডিজাইনের পেছনে খরচ করেছেন ২৭ লাখ টাকা, ফ্ল্যাটের ইলেক্ট্রনিক্স ও ফার্নিচারের পেছনে ব্যয় করেছেন ৩৫ লাখ টাকা। তবে ফ্ল্যাট কেনার পর ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা নিয়েছেন ফ্ল্যাট কেনার এক বছর পর।

এ ছাড়া আরজিনা খাতুনের নিজস্ব একটি প্রাইভেট কার রয়েছে, যার নম্বর গ-১৬-৭৪৫৮। ওই কারটি নিজের অর্থ দিয়ে কেনা হলেও কারটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ‘আনবি লজিস্টিক লিমিটেড’-এর নামে রেজিস্ট্রেশন করেন। ওই সিঅ্যান্ডএফ কোম্পানির মালিকও আরজিনার সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

দুদকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কাস্টমসের চাকরির আগে আরজিনা খাতুনের গ্রামের বাড়িতে ছিল ২০ ফুটের একটি টিনের ঘর। ওই টিনের ঘরের একটি অংশ পার্টিশন দেওয়া ছিল। সম্প্রতি তার গ্রামের বাড়িতে ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। ফার্নিচার ও ইলেক্ট্রনিক্সখাতে ব্যয় করা হয়েছে আরও অন্তত ৩৫ লাখ টাকা।

অভিযোগে বলা হয়, আরজিনা খাতুনের বাল্যবন্ধু হিসেবে সবার কাছে পরচিতি মো. আবু তাহের। তিনি এয়ারপোর্ট সংলগ্ন কাওলায় ব্যবসা করেন। আরজিনা চট্টগ্রাম কাস্টমসে থাকাকালে পিয়ন ইলিয়াস ও তার গাড়িচালক শাহজাহান আকতারকে দিয়ে টাকা পাঠাতেন দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। একটির নাম নিরো এন্টারপ্রাইজ, অপরটি বেঙ্গল ট্রেডিং। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডে অ্যাকাউন্টগুলো রয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, আরজিনা তার বাবা আহম্মদ আলীর কাছে সোনালী ব্যাংকের বালিয়াকান্দি শাখার অ্যাকাউন্টে এবং মা-বাবা উভয়ের কাছে বিকাশে টাকা পাঠাতেন। শুধু তাই নয়, ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তার আপন দুই ছোট ভাইয়ের নামে ৪০ বিঘা জমি কিনেছেন আরজিনা। বর্তমানে সেখান থেকে ৩০ বিঘা জমি বন্ধক রাখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় অভিযোগে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে আরজিনার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের তালুকপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেই টিনের ঘরটি এখন আর নেই। সেখানে আলিশান বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। তার বাড়িতে গেলেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

তালুকপাড়া গ্রামের বেশ কয়েকজন বলেন, আহম্মদ আলী একজন দিনমজুর। মাছ শিকার ও চাষাবাদ করে সংসার চলত তার। দুই ছেলে, এক মেয়ে তার। মেয়ে আরজিনা খাতুন অল্প দিনেই অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছেন। নারুয়া বাজারে জমি কিনে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। বালিয়াকান্দি শহরে ও রাজবাড়ী শহরে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। মাঠে ১০-১২ পাখি (২২ শতাংশে ১ পাখি) জমি কিনেছেন।

নারুয়া বাজারের ঘর ভাড়া দিয়েছেন আরজু নামের এক ব্যবসায়ীর কাছে। তিনি বলেন, ‘আরজিনা খাতুনের ভাই মতিন বাজারে জমি কিনে টিনের ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে। তবে এটা আরজিনার কি না, বলতে পারব না।’

নাম না প্রকাশের শর্তে একজন থ্রি-হুইলারচালক বলেন, ‘আরজিনা খাতুনের মাকে একটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে তার ৭০ হাজার টাকা মুল্যের একটি স্বর্ণের চেইন হারিয়ে যায়। পরে আরজিনাকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ও নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই, এটা আমার এক মিনিটের কামাইয়ের সমান নয়’’।’

আব্দুল আলিম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘(আরজিনাকে নিয়ে) বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা শুনছি। ছাগলকাণ্ডেরর মতিউরের সঙ্গে আরজিনার নাকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মাত্র ৩ বছরে এত সম্পদ হয়েছে! বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত আরজিনা খাতুনের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে সব অভিযোগ মিথ্যা ও কাল্পনিক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার পর থেকেই এভাবে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করছেন। তিনি এ বিষয়ে মামলা দায়ের করেছেন। উল্টো তার বিরুদ্ধেও মামলা করেছেন। এখন তিনি চরম অশান্তির মধ্যে রয়েছেন। তবে দুদক ডাকলে তার জবাব দেবেন বলে জানান।

উল্লেখ্য, ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে যাওয়া মতিউরের দুই স্ত্রী রয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম শাম্মী আখতার শিভলী।

Related posts

Leave a Comment