শাফিন আহমেদ মারা গেছেন

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

দেশের ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। যুগে যুগে হয়তো অনেক মিউজিশিয়ানই আসবেন; কিন্তু শাফিন আহমেদ আর ফিরে আসবেন না। তার বাজানো এবং গায়কীতে অন্যরকম এক উপস্থিতি ছিল, যা সবার থেকে তাকে করেছিল আলাদা। অনেকের কাছে তিনি ছিলেন জীবনের চেয়ে বড়। কারণ তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক মিউজিশিয়ানই স্বপ্ন দেখতেন একদিন শাফিন আহমেদের মতো হবেন। ব্যান্ড সংগীতের এই কিংবদন্তির বিদায়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ব্যান্ড সংগীত জগতে। সহকর্মীদের স্মরণেই আজকে আমাদের এ মূল আয়োজন।
শাফিন আহমেদের বিদায়বেলায় তার আত্মার জন্য শান্তি কামনা করেছেন রকস্টার নগর বাউল জেমস। বর্তমানে তিনি কনসার্ট করতে কানাডায় রয়েছেন। সেখান থেকে শাফিন আহমেদের একটি ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি, নও পাহাড়ি ঝরনা, যদি বলি ফুল তবুও হবে ভুল, তোমার তুলনা হয় না। বিনম্র শ্রদ্ধা—বাংলাদেশের মাইলস ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ আর নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শোকস্তব্ধ দর্শকশ্রোতাদের প্রতি রইল গভীর সমবেদনা। আসুন আমরা সবাই তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।’ জেমসের এমন হৃদয়বিদারক স্ট্যাটাস মুহূর্তেই শ্রোতাদের আরও বেশি শোকাহত করে।
শাফিন আহমেদের বিদায়ে শোকাহত গোটা ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। ওয়ারফেজ ব্যান্ডের দল নেতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য শেখ মনিরুল আলম টিপু কালবেলাকে বলেন, ‘আমি বৃহস্পতিবার সকালেই শাফিন ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদটি পেয়েছি। যেই সংবাদ আমাকে তৎক্ষণাৎ বাকরুদ্ধ করে ফেলে। অনেকেই কল দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হতে চায় আমার কাছে। কিন্তু আমি নিজেই এটি বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলাম না। এমনটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। তার মতো একজন মিউজিশিয়ান যুগে যুগে আসে না। তিনি দেশের ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জন্য যা করে গেছেন, তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেক অনেক বছর সাধনা করতে হয়। অনেক সময় বিধাতা না চাইলে সাধনাতেও হয় না।’ এ সময় শাফিন আহমেদের শারীরিক অবস্থা ও তার মিউজিকের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে টিপু আরও বলেন, ‘ভাই দীর্ঘসময় ধরে অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু স্টেজ ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে কখনোই ছিলেন না। চিকিৎসা নিতেন। আবার স্টেজে ফিরতেন। এভাবেই চলছিল তার গত কয়েক মাসের জীবনযাপন। তবে একটি কারণে তাকে আমি সবার থেকে আলাদা করব, সেটি হচ্ছে—আমাদের দেশে কিন্তু কমপ্লিট মিউজিশিয়ান খুব বেশি নেই। হাতেগোনা কয়েকজন। তিনি তার মধ্যে একজন। আর তিনি যেসব গানে কণ্ঠ দিয়ে গিয়েছেন, এসব গানই তাকে শত শত বছর শ্রোতাদের হৃদয়ে জীবিত রাখবে। পারিবারিকভাবেও সংগীতের স্বচ্ছ শিক্ষা পেয়েছেন তিনি। তার বাবা এবং মা দুজনই সংগীতের উচ্চমর্যাদাপূর্ণ শিল্পী ছিলেন। তাদের গর্বিত সন্তান তিনি। শাফিন ভাই আমার কাছে যেখানে সবার থেকে আলাদা ছিলেন। সেটি হলো বেজ বাজাতে বাজাতে স্টেজে পারফর্ম করা আমাদের দেশে অসম্ভব একটি ব্যাপার। সেখানে তিনি অবলীলায় এই কাজটি যুগের পর যুগ করে গেছেন। এখানেই তিনি সবার থেকে আলাদা। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
শাফিন আহমেদের মৃত্যুতে নিজের ভাই হারানোর শোক অনুভব করছেন দেশের আরেক জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা রায়েফ আল হাসান রাফা। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘শাফিন ভাই ছিলেন আমার কাছে লার্জার দ্যান লাইফ। জীবনের চেয়ে বড়। আজকের এই রাফা হওয়ার পেছনে তার অবদানের কথা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। কারণ ছোটবেলায় আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে মাইলস এবং শাফিন আহমেদের কথা শুনতাম। এরপর তাকে যখন রিড করা শুরু করলাম, তখন প্রতিটি বিষয় আমার কাছে অসম্ভব মনে হতো। কীভাবে মানুষ মিউজিক নিয়ে এতটা পারে সে বিষয়ে প্রশ্ন জাগত। যখন তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো, তার সঙ্গে কাজের সুযোগ আসতে থাকল তখন বুঝলাম, এটাই একজন মিউজিশিয়ানের জীবন। কারণ তার জীবনে মিউজিক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সারাটি জীবন তিনি দেশের ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে কাজ করেছেন। এর উন্নতি নিয়ে ভেবেছেন। আমাদের মতো প্রজন্মর জন্য কিছু একটা রেখে যেতে চেয়েছেন। যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে। সেই মানুষটি আজ পৃথিবীর ম্যায়া ত্যাগ করেছেন। এটি আমাদের ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং দেশের জন্য কালো একটি দিন। সবশেষ একটি গল্প বলি, আমি যখন সবে শুরু করি ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়স। তখন অর্থহীনের সুমন ভাই আমরা এবং শাফিন ভাইরা একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম মাঝেমধ্যে। হঠাৎ একদিন সুমন ভাই বলেন, শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে একটি স্লো গানে ড্রাম বাজানোর কথা, আমি শুনে ভয়ে না করে দিই। কারণ যেই মানুষটির সঙ্গে ছবি তুলতে আমার হাত-পা কাঁপত, সেই মানুষটির সঙ্গে বাজানোর সাহস তখন ছিল না। এরপর একসঙ্গে অনেক কনসার্ট করা হয়েছে। এখন এটাই খারপ লাগছে, শেষ সময়ে দেখাটাও আর হলো না।’
কনসার্টের জন্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে ব্যান্ড চিরকুট। শাফিন আহমেদের মৃত্যুতে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে শোকবার্তা। শাফিনের ছবি দিয়ে লেখা হয়, বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিকের অন্যতম কিংবদন্তি ব্যান্ড মাইলসের প্রাক্তন ভোকালিস্ট এবং বেইজিস্ট শাফিন আহমেদ ভাই আমেরিকায় মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাংলা ব্যান্ড সংগীতে তার অবদান অনেক। আমরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
শাফিন আহমেদের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মা কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম এবং বাবা সংগীতজ্ঞ কমল দাশগুপ্ত। এই পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই শাফিন আহমেদ গানের ভেতরেই বড় হন। শৈশবে বাবার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছেন আর মায়ের কাছে শিখেছেন নজরুলসংগীত। শাফিন আহমেদ স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে গেছেন। এর মধ্যে বড় ছেলে আযরাফ ওজি র‍্যাপ সংগীতের সঙ্গে আছেন। বাবার মৃত্যুতে গোটা পরিবার শোকাহত।

Related posts

Leave a Comment