শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় নতুন করে মামলা করা হচ্ছে। এসব ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা তদন্ত করে গুলিবর্ষণকে যথার্থ বলে প্রতিবেদন দেওয়া ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হচ্ছে। বিগত আমলে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের একটা অংশ বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী।
কথিত এসব বন্দুকযুদ্ধকে সব সময়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। এসব ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে মামলা দায়েরে সহযোগিতা করছে বিএনপির একটি তদন্ত সেল। এই সেলের প্রধান করা হয়েছে পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তাকে।
জানতে চাইলে বিএনপির ওই সেলের প্রধান পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ক্রসফায়ারের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ শুনে, মামলা করার ব্যাপারে তাঁদের সহযোগিতা করছি। আমরা চাই, এসব মামলায় যেন ঘটনা তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটদেরও আসামি করা হয়। কারণ, কথিত বন্দুকযুদ্ধের দায় তদন্তকারী হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটরাও এড়াতে পারেন না।’ সালাহ উদ্দিন খান একসময় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন।
বিএনপির সূত্র জানায়, ‘ক্রসফায়ারের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার মামলাগুলো পরিচালনার জন্য গঠিত তদন্ত সেলের কার্যালয় খোলা হয়েছে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ছয়তলায়। সারা দেশে ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার ব্যক্তিদের পরিবার এই সেলে অভিযোগ জমা দিচ্ছে। সেল মামলা করতে সহযোগিতা করছে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা মামলা করেছে। এগুলোর এজাহারের বর্ণনা গড়পড়তা একই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই ঘটনায় নতুন করে হত্যা মামলা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছয়টি মামলা করা হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাগুলো তদন্তের কথা বলা হলেও, সেসব তদন্তের প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশ্যে আসেনি। তদন্তের ভার অনেক সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে থাকায় আসল চিত্রও জানা যায়নি। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ থেকেই গেছে।
জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ এবং জাতিসংঘের আপিল আদালতের সাবেক বিচারক ড. শাহজাহান সাজু গত শুক্রবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যার ঘটনায় আসলে কী হয়েছে, তা নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া বোঝার উপায় নেই। এখন যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ মামলা করা শুরু করেছে, সেটার স্বাধীন তদন্ত হোক। সেখানে কার কী অবস্থান ছিল, সব উঠে আসবে।
বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্প সাজিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আবার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ব্যক্তির সহযোগী দাবি করে নামে-বেনামে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে হত্যা মামলা দিয়েছে, গ্রেপ্তার করেছে।
বিএনপির তদন্ত সেলের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দলের ১ হাজার ৫৫১ জন নেতা-কর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন ৮৩৭ জন, যার বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে। গত ১৭ বছরে গুম হওয়া ১ হাজার ২০৪ জনের মধ্যে বিএনপির ৪২৩ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুমের বেশির ভাগ ঘটনারই তদন্ত হয়নি। যেগুলোর তদন্ত হয়েছে, সেগুলোও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করতে হয়েছে। তবে তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ওই গুলিবর্ষণকে ‘যথার্থ’ বলা হয়েছে।
দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে, গুলিবর্ষণের যেকোনো ঘটনা নির্বাহী বিভাগের তদন্ত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ কারণে প্রতিটি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনার তদন্ত হয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় বন্দুকযুদ্ধের নামে কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারেন ম্যাজিস্ট্রেট।
পুলিশ প্রবিধানের (পিআরবি) ১৫৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলে তা যুক্তিযুক্ত হয়েছে কি না, তা নির্ধারণের জন্য যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত করতে হবে। তদন্ত শেষ হলেই তদন্তকারী কর্মকর্তা সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠাবেন এবং পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পেশ করতে প্রতিবেদনের অনুলিপি পুলিশ সুপার বা রেঞ্জের ডিআইজির কাছে পাঠাবেন।
তবে তথ্য বলছে, অপারেশন ক্লিন হার্ট থেকে শুরু করে কিছুদিন আগে পর্যন্ত পুলিশ বা র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধ কিংবা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় সেভাবে কাউকে দায়ী করা হয়নি, ফলে কারও সাজার নজিরও নেই।
মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যে বা যাঁরা বন্দুকযুদ্ধকে বৈধতা দিয়েছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কিংবা আমলা যে-ই হোন না কেন। এখন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর উচিত, স্বজনকে হত্যার সঙ্গে যাঁরা, যে পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে আসামি করে বিচার চাওয়া। যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের বিচার করা উচিত।’
‘বন্দুকযুদ্ধের’ প্রতিটি ঘটনাকে ভুক্তভোগীর পরিবারকে ‘সাজানো গল্প’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। পরিবারগুলো বলছে, এখন নিরপেক্ষ তদন্ত হলে সেগুলো যে সাজানো ছিল, তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। জড়িত ব্যক্তিরা চিহ্নিত হবেন। পরিবারগুলো মামলা করতেও শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ঢাকা, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও নীলফামারীতে ছয়টি মামলা করা হয়েছে। ঢাকার খিলগাঁওয়ে ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে হত্যার অভিযোগে ৩ সেপ্টেম্বর ওই থানায় মামলা করেন তাঁর বাবা ইয়াকুব আলী। মামলায় পুলিশের সাবেক-বর্তমান ১৩ কর্মকর্তাসহ আসামি হিসেবে ৬২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরায় ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই বিএনপির কর্মী আনিছুর রহমানকে (২৮) গুলি করে হত্যার অভিযোগে তৎকালীন পুলিশ সুপার, চার পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। নিহত আনিছুরের ভাই মকফুর রহমান সাতক্ষীরার আদালতে মামলাটি করেছেন। তিনি বলেন, ‘নামমাত্র তদন্ত করে হত্যাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এত দিন দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিচার চাইতে পারিনি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে যেভাবে জড়িত, সবারই উপযুক্ত বিচার চেয়েছি।’
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বিতর্কিত কয়েকটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটরা বৈধতা দিয়েছেন। এখন তাঁদের নামে মামলা হতেই পারে। তদন্তে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট কে কতটুকু দোষী, তা বের হলে সে অনুযায়ী বিচার হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, এখন পরিবেশ ও পরিস্থিতি নাজুক। খুব সচেতনভাবে বিষয়গুলো দেখভাল করা উচিত।