শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীনে বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ কাজেই গত ১৪ বছরে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি থেকে ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বুধবার (৯ অক্টোবর) সকালে ধানমন্ডির টিআইবির কার্যালয়ে ‘সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনে এ তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি।
গবেষণাটি পরিচালনা করেন টিআইবির সহযোগী গবেষক মো. মোস্তফা কামাল ও জ্যৈষ্ঠ গবেষক মো. জুলকারনাইন। যেখানে নিজস্ব অর্থায়নে সর্বোচ্চ এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এরমধ্যে নির্মাণ কাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয় ১০-২০ শতাংশ। নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ প্রাপ্তি ও ঠিকাদারের বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয় ১১-১৪ শতাংশ। দরপত্র লাইসেন্স ভাড়া, কার্যাদেশ বিক্রয়, সমঝোতা, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরও প্রায় ২-৬ শতাংশ ঘুষ দিতে হয় বলে জানায় সংস্থাটি।
এসময় কিছু ক্ষেত্রে একদিনের মধ্যে প্রকল্প প্রণয়ন, পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প অনুমোদন সভায় দ্রুততার সাথে প্রস্তাব উত্থাপন এবং গোপনে প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে সওজের কোনো কোনো কর্মকর্তা পরিকল্পনা কমিশনের কিছু কর্মচারীদের ২-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়ারও কথা জানায় টিআইবি।
টিআইবি জানায়, উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ সংশ্লিষ্ট কার্যাদেশ ও বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কার্যাদেশের মোট অর্থ মূল্যের ১১-১৪ শতাংশ ঘুষ বাণিজ্য হয়। যার মধ্যে ঠিকাদারি কার্যাদেশ পেতে ৫-৫ শতাংশ পর্যন্ত টাকা ঘুষ দিতে হয়। আর বাকি ৬-৮ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় কাজ সরেজমিনে পরিদর্শন ও বিল প্রাপ্তির জন্য। যেখান থেকে প্রকল্প পরিচালকসহ সওজ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের ক্রয় কমিটি, দরপত্র উন্মুক্ত ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ০.১৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ বণ্টন করা হয়।
২০০৯-১০ থেকে ২০২৩- ২৪ পর্যন্ত সময়ে সওজ-এর উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি কার্যাদেশ ও বিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সওজ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ১৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা থেকে ১৭ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সড়ক ও মহাসড়ক খাতে রাজনীতিবিদ, সংশ্লিষ্ট আমলা ও ঠিকাদারের ত্রিপাক্ষিক আঁতাতের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমের নীতি নির্ধারণ, সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে করায়ত্ত করা হয়েছে।
ফলে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সুশাসনের সব মানদণ্ডে ব্যাপক ঘাটতি চিহ্নিত হয়েছে।
আরও বলা হয়, ত্রিপাক্ষিক যোগসাজশের মাধ্যমে সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে এবং কিছু দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা ও ঠিকাদার অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ নিয়মবহির্ভূত অর্থ উপার্জনের অবাধ সুযোগ করায়ত্ত করেছে। দুর্নীতির লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
গবেষণা উপস্থাপনে সংস্থাটি জানায়, একদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অতি উচ্চ ব্যয়ে এ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, অন্যদিকে নির্মিত সড়ক ও সেতুর মান খারাপ হচ্ছে ও টেকসই হচ্ছে না- যা প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জনকে ব্যাহত করছে এবং জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার ও বিপুল অপচয় হচ্ছে।
টিআইবি জানায়, গবেষণা করতে ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
গবেষণায় বিশ্লেষিত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা ও যথার্থতা যাচাইয়ে গুণগত গবেষণার বিভিন্ন-পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে বলেও জানায় টিআইবি।
গবেষণায় সড়ক নির্মাণ, সড়ক উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ, সেতু উন্নয়ন (অনূর্ধ্ব ১৫০০ মি.) ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ সম্পর্কিত প্রকল্প পর্যবেক্ষণ, সমাপ্ত প্রকল্প সংখ্যা, ধরন, বরাদ্দ ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ১০টি জোনের ১৩টি সার্কেলের ২১টি বিভাগীয় দফতরের (জেলা পর্যায়) আওতাধীন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সংস্থাটি।
গবেষণা উপস্থাপনের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা অধ্যাপক সুমাইয়া খাইর, পলিসি রিসার্চ পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান ও কমিউনিকেশন পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।