চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনা সংঘের (ইসকন) নেতা ও সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ প্রভু ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার ও তার জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। একপর্যায়ে সাইফুল ইসলাম নামের এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে চিন্ময়ের অনুসারীরা। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
নিহত ওই আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫)। তিনি চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এদিকে পুলিশের লাঠিচার্জে ৬ জন চিন্ময় অনুসারী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেন- শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক।
চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন সমকালকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় মারামারিতে আহত আলিফ নামে এক আইনজীবীকে হাসপাতালে আনা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কোর্ট বিল্ডিং এলাকা থেকে আহত আরও ৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে চিন্ময় কৃষ্ণকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ষষ্ঠ আদালতের বিচারক কাজী শরিফুল ইসলামের আদালত তোলা হয়। পরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আদালত চিন্ময় কৃষ্ণকে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিকেল ৩টায় পুলিশ, সোয়াত ও বিজিবি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করে চিন্ময়কে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়।
চিন্ময় সমর্থকরা আদালত মসজিদের নিচতলায় থাকায় আইনজীবীর চেম্বার ও দোকান ভাঙচুর করেন। বিকেল ৪টার দিকে রঙ্গম কনভেনশন হলের সামনে প্রধান সড়কে চিন্ময় সমর্থকদের সঙ্গে ক্ষুব্ধ আইনজীবী ও জনতার সঙ্গে সংর্ঘষ হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে এক আইনজীবী গুরুতর আহত হন। পরে তাকে চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজুর রহমান বলেন, সকালে আসামি চিন্ময়কে আদালতে তোলা হলে শুনানি শেষে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। তাকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজনভ্যানে তোলা হলে তার অনুসারীরা প্রিজনভ্যান অবরোধ আশপাশে অবস্থান নেন। বারবার অনুরোধ করা হলেও অবস্থানকারীরা সরে যাননি। পরে বিকেলে পুলিশ, বিজিবি ও সোয়াত তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী স্বরূপ কান্তি নাথ বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন নামঞ্জুরের পর মিস মামলা করে আমরা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করি। আদালত আবেদনটি আগামীকাল বুধবার শুনানির জন্য রেখেছেন। চিন্ময়ের অনুসারীরা সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবেই আদালত ভবনের নিচতলায় অবস্থান করছিলেন। বিকেলে পুলিশ, বিজিবি বিনা উস্কানিতে সনাতনীদের ওপর লাঠিচার্জ ও হামলা করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকেই শত শত নারী-পুরুষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে বহন করা প্রিজনভ্যান আটকে বিক্ষোভ করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্ময় অনুসারীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা ছিল। দুপুর দুইটার দিকে পুলিশ অবরোধকারীদের সরানোর চেষ্টা করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তখন আদালতপাড়ার নিচতলায় মালখানার পুরনো একট মিনি ট্রাক ও একটি নোহা প্রিজনভ্যানের সামনে সড়কে এনে অবরোধ সৃষ্টি করেন। অনেক অবরোধকারীকে তখন মাটিতে শুয়ে পড়তে দেখা যায়।
আদালতপাড়ায় উত্তেজনা বেড়ে গেলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলাম এর চেম্বার মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট মফিজুল হক ভুইয়া, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাজকে ঢুকতে দেখা যায়। তখন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বাইরে শতাধিক চিন্ময়ের আইনজীবী মিস মামলা শুনানি করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনই আদালত ভবনের নিচতলায় অবস্থান নেওয়া কয়েকশ পুলিশ, সোয়াত ও বিজিবি সদস্যরা একযোগে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়েন। পরে অবরোধকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেন। এসময় চিন্ময় অনুসারীরা সড়কের পাশে পার্কিং করা গাড়ি ভাঙচুর করেন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলা পরিষদের সামনে শতাধিক ক্ষুব্ধ আইনজীবী ও অবরোধ বিরোধী মানুষ চিন্ময় অনুসারীদের রঙ্গম কনভেনশন গলির দিয়ে ধাওয়া করেন। তখন চিন্ময় অনুসারীরাও পাল্টা ধাওয়া দেয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় আলিফ নামে এক আইনজীবীকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। কোপের আঘাতে তার শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ হতে থাকে। তাকে দ্রূত চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মারা যান।
এর আগে সোমবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করেন। গত ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, নিউমার্কেট মোড়ের স্বাধীনতা স্তম্ভে জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হয়েছে। মামলার জেরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে সনাতনীদের আন্দোলন ইস্যুতে চিন্ময় কৃষ্ণকে ইসকন থেকে বহিস্কার করা হয়।
চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত জনসংযোগ কর্মকর্তা আজিজ বলেন, এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা মাঠে সর্তক অবস্থানে রয়েছে। সনাতনীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।