ইনসানে কামিল

-ডাঃ মৌলভী কাজী আবদুর রহমান

পর্ব-আট

উম্মুল মোমেনীনদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- এর মহীয়সী ১১জন স্ত্রীর পরিচয়)

 

নবী করিম (সাঃ) যাঁদের বিবাহ করেছিলেন তাদেরকেই উম্মুল মোমেনীন বলা হয়। এই মহীয়সীরা ছিলেন মোট ১১ জন। নিম্নে এঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো :-

১। হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রাঃ):-
তিনি ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রথম স্ত্রী। মক্কার লোকেরা তাঁর নির্মল চরিত্র মাধুর্য্যে মুগ্ধ হয়ে নাম দিয়েছিলেন তাহেরা বা নির্মল চরিত্রের অধিকারিণী কন্যা। তাঁকে উম্মুল হিন্দ নামেও ডাকা হতো। তিনি ৫৫০ খৃস্টাব্দে এক শুভ প্রভাতে খুওয়াইলিদের ঔরসে মাতা বিবি ফাতিমার গৃহে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন কোরাইশ বংশধর।
তাঁর পিতা ছিলেন একজন উচচশিক্ষিত ও জ্ঞানী লোক। পিতা-মাতার সান্নিধ্যে থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি তাওরাত ও ইঞ্জিন কিতাব উত্তম রূপে শিক্ষা লাভ করেন।
আবু হালা হিন্দ ইবনে নাবাশ তামিমী নামক এক সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত যুবকের সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়। তার মৃৃত্যুর পর আতিব বিন আয়েদ মাখজুমী নামক উচচ বংশীয় এক শিক্ষিত যুবকের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এই দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর কারো কারো মতে তারই চাচাত ভাই সাঈফী ইবনে উমাইয়ার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। আবার কারো কারো মতে এই তৃতীয় বিবাহটি হয় আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে। তখন তাঁর বয়স ছিলো প্রায় ৪০ বৎসর।
হযরত রাসুলে করিম (সাঃ) ও হযরত খাদিজা (রাঃ) উভয়ে উভয়ের প্রতি অকৃতিম ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তাই দেখা যায় স্বামীর মুখে দ্বীনের দাওয়াত পেয়ে দ্বীধাহীন চিত্তে তিনিই প্রথম ইসলামের দাওয়াত কবুল করে নেন।
নবীজির ঔরশে ও তাঁর গর্ভে পাঁচ সন্তান জন্ম গ্রহন করেন।
এরা হলেন-
(১) হযরত কাসেম (রাঃ)। নবীজির বিবাহের পঞ্চম বর্ষে তার জন্ম হয় (২) হযরত জয়নাব (রাঃ)। তিনি অষ্টম হিজরীতে ইনতেকাল করেন (৩) হযরত রোকাইয়া (রাঃ)। তিনি নবীজির ৩৩ বছর বয়সে জন্ম গ্রহন করেন (৪) হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এবং (৫) হযরত ফাতেমা (রাঃ)। তিনি নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে জন্মগ্রহণ করেন।
নবীজির চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর পর হযরত খাদিজা (রাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। মিরাজের পূর্বে ১০ম বছরের ১০ রমজান ৬৫ বৎসর বয়সে তিনি ইনতেকাল করেন। এই মহীয়সী নারী নবীজির সাথে দীর্ঘ ২৪ বৎসর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁকে হুনন বা হাজুন নামক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

২। হযরত সাওদা বিনতে জামআ (রাঃ):-
কুরাইশদের একটি প্রসিদ্ধ লুওয়াই-বিন-আমের গোত্রে হযরত সওদা বিনতে জামআ (রাঃ) জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর মাতা ছিলেন মদিনার নাজ্জার বংশের মেয়ে।
প্রথম স্বামী সাকরান-বিন-আমের এবং নবী করিম (সাঃ)- এর প্রথম স্ত্রী পূণ্যবতী হযরত খাদিজা (রাঃ)- এর মৃত্যুর পর চার শত দেরহাম মোহরানায় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)- এর সঙ্গে সাওদার বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিবাহের সময় হযরত সওদার বয়স ছিলো ৫৫, অপর দিকে রাসুলে করিম (সাঃ) বয়স ছিলো ৫১ বৎসর।
নবুয়তের প্রথম দিকেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। দুই নাবালক সন্তান উম্মে কুলসুম ও ফতিমাকে মানুষ করা এবং সংসার দেখাশুনা করার দায়িত্ব নিতেই তিনি রাসুলে করিম (সাঃ)- এর গৃহে আসেন। এ ছাড়া আল্লাহর রাসুলের (রাঃ) সেবা যত্ন এবং কন্যা দু’টিকে তিনি এতো ভালবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে মানুষ করেন যে কেউ ভুলেও মনে করতে পারতো না যে তিনি তাদের আপন মা নন।
তাঁর মৃত্যুর সন নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। ইমাম বোখারীর সনদের বর্ণনা মতে ২৪ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৩। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বিনতে আবু বকর (রাঃ):-
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা নবুয়তের ১ম বর্ষের শেষের দিকে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন রাসুলে পাকের প্রধান সহচর এবং ইসলামের প্রথম খলিফা। তাঁর মাতার নাম উম্মে রওমান।
তখনকার দিনে আরব দেশে লেখা পড়া শিক্ষার নিয়মিত কোন ব্যবস্থা ছিলো না। কিন্তু ইসলাম প্রচার হওয়ার পর আল্লাহর পবিত্র কালাম শিক্ষাই তাদের একমাত্র বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) পিতার মুখে শুনে শুনেই কোরআনের আয়াত মুখস্ত করে নিতেন।
হিজরতের দুই বৎসর পাঁচ মাস আগে মাত্র ছয় বৎসর বয়সে তাঁকে বিবাহ দেয়া হয়। কিন্তু হিজরতের সাত মাস পরে অর্থাৎ নয় বৎসর বয়সে তাঁকে স্বামীর গৃহে পাঠানো হয়। নবীজির ১১ জন স্ত্রীর মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্ব কনিষ্ট এবং কুমারী।
উম্মুল মোমেনীনদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী এবং ফকিহ। হাদিস বর্ণণা কারীদের মধ্যে তাঁর স্থান বেশ উঁচুতে। তিনি সর্বমোট ২৬৮টি হাদিস বর্ণনা করেন। হিজরী ৫৮ সনের রমজান মাসের ১৭ তারিখে তারাবিহ্ নামাজের পর তিনি ইনতেকাল করেন।

৪। হযরত হাফসা বিনতে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ):-
পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ও মাতা যয়নব বিনতে মযউন- এর কন্যা হযরত হাফসা (রাঃ) প্রথম স্বামী খুনাইস-বিন-হুযায়ফার মৃত্যুর পর তার উগ্র মেজাজের জন্য কেউ তাঁকে বিবাহ করতে রাজি না হওয়ায় কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার অনুরোধে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁকে বিবাহ করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
উম্মুল মোমেনীন হযরত হাফসা (রাঃ) ছিলেন পবিত্র কোরআনের সংরক্ষক। হযরত উমরের মতো তাঁর মেজাজ বেশ কড়া হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহ ভীরু, অধিক ইবাদতকারী এবং রোযা পালনকারী। তিনি মৃত্যু অবধি রোজা রেখেছিলেন।
তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং হিজরী ৪৫ সনে ইন্তেকাল করেন।

৫। হযরত জয়নব বিনতে খেযায়মা (রাঃ):-
হযরত জয়নব (রাঃ) ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) পঞ্চম স্ত্রী। প্রথম স্বামী তালাক দিলে আবদ আল্লাহ ইবনে জাহশ- এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু উহুদের যুদ্ধে সত্তর জন মুসলমান শহীদের সাথে তিনিও শহীদ হয়ে যান। ফলে মদীনার প্রায় অর্ধেক মুসলিম নারীদের মতো হযরত জয়নবও (রাঃ) অসহায়, রিক্ত, নিঃসঙ্গ ও বৈধব্য জীবন যাপন করতে থাকেন। জগৎ সংসার তাঁর কাছে অর্থহীন ও অন্ধকার মনে হতে থাকে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিধবা নারীদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও মর্যদা দানের জন্য আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ৪০০ শত দেহরাম মোহরানার বিনিময়ে তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
হযরত জয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) ছিলেন অতিশয় উদার, দয়ালু, নিঃস্ব এবং গরীব দুঃখীদের বন্ধু। এ জন্য তাঁকে “উম্মুল মাছাকীন” নামে অভিহিত করা হতো। “উম্মুল মাছাকীন” শব্দের অর্থ হচেছ আর্ত মিছকীনদের জননী।
বিবাহের মাত্র তিন মাস পর তিনি ইন্তেকাল করেন।

৬। হযরত সালমা হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া (রাঃ):-
পিতা আবু উমাইয়ার কন্যা সালমা ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)- এর ষষ্ঠ স্ত্রী। তাঁর প্রকৃত নাম হিন্দ, উপনাম উম্মে সালমা। কুরাইশ বংশের মখযুম শাখায় তাঁর জন্ম।
প্রথম স্বামী আবদুল্লাহ ইবনে আবদিল আসাদ যার উপনাম আবু সালামা উহুদের যুদ্ধে আহত হওয়ার কিছু দিন পর ইনতেকাল করলে চার সন্তান নিয়ে তিনি অত্যন্ত নিঃসহায় ও দুঃখ দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাতে থাকেন। তখন প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁকে বিবাহ করেন।
মহিলাদের মধ্যে তিনিই সর্ব প্রথম হিজরত করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। খুব সুন্দর সুরে পবিত্র কোরআন তেলোয়াত করতে পারতেন। তাঁর কাছে থেকে ৩৭৮টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
৬৩ হিজরীতে ৮৪ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে সমাহীত করা হয়।

৭। জয়নব বিনতে জাহাশ ইবনে রিয়াব (রাঃ):-
তিনি ছিলেন রাসুলে পাকের ফুফাতো বোন। হযরত জায়েদ ইবনে হারেসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। হযরত জায়েদ ছিলেন রাসুলে পাকের খাদেম। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে আপন সšতানের মতো ভালবাসতেন এবং লালন পালন করতেন। হযরত জায়েদের সাথে জয়নবের বনিবনা না হওয়ায় এক সময় তাঁদের মধ্যে বিবাহ বিচেছদ হয়ে যায়।
মহান আল্লাহ অত্যন্ত হিকমত ওয়ালা। তিনি কি জন্য কি করেন তা বুঝার সাধ্য কারো নেই। হযরতের সঙ্গে (সাঃ) জয়নবের বিবাহ সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন-
“অতঃপর জায়েদ যখন জয়নবের সাথে বিবাহ স¤পর্ক ছিন্ন করলো তখন আমি তাঁকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করালাম। যাতে মুমিনদিগের পুষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ সূত্র ছিন্ন করলে সেই সব রমনীকে বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়।” (সুরা আহযাব, আয়াত ৩৭)
হযরতের (সাঃ) সাথে হযরত জয়নব (রাঃ)- এর বিবাহ হয় পঞ্চম হিজরীতে।
তখনকার সময়ে আরব দেশের প্রচলিত রীতি অনুসারে পালক পুত্র হিসাবে কেউ কাউকে গ্রহন করলে সেও ঔরশজাত সন্তানের মর্যাদা এবং অধিকার ভোগ করতো। পালক পুত্রের স্ত্রী তালাক প্রাপ্ত হলে কিংবা বিধবা হলে পালক পিতার পক্ষে তাকে বিবাহ করা বৈধ মনে করা হতো না। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম চলে আসছিলো। জাহেলী যুগের এই কুসংস্কার নির্মূল করার লক্ষ্যেই আল্লাহ পাক জায়েদের তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে রাসুলে পাকের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার নির্দেশ দেন।
ডবধান দাতা আল্লাহ পাক আরো বলেছেন-
“মা কানা মোহাম্মাদুন আবা আহাদিম মির রিজা লিকুম অলা কির রাসুলাল্লাহি ওয়া খাতামান নাবিই ঈন।
অর্থাৎ মোহাম্মদ (সাঃ) তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহ রাসুল এবং শেষ নবী।”
সুরা আযহাবের চতুর্থ আয়াতে আরো বলা হয়েছে-
“ আল্লাহ কোন মানুষের অভ্যন্তরে দু’টি হৃদয় সৃষ্টি করেন নাই। তোমাদের স্ত্রীগণ যাদের সাথে তোমরা জিহ্যার করে থাক, তাদেরকে তোমাদের জননী করেন নাই এবং তোমাদের পুষ্য পুত্র করেন নাই। এগুলো তোমাদের মুখের কথা। আল্লাহ সত্য কথাই বলেন এবং তিনিই সরল পথ নির্দেশ করেন।”
এ থেকে ¯পষ্ট বুঝা যায় যে, পালক পুত্রের তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীকে বিবাহ করা পালক পিতার জন্য না জায়েজ হবে না।

৮। জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস (রাঃ):-
হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ) ছিলেন বনী মুস্তালিক গোত্রের প্রধান হারেস বিন আবু দিরারের কন্যা। স্বামীর নাম মুসাফে বিন সফওয়ান। তাঁর পিতা ও স্বামী উভয়েই ইসলামের শক্র ছিলো। তারা উভয়ে হযরত রাসুলে করিম (সাঃ)- এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে মদীনা থেকে নয় মাইল দূরে মুরাইসী নামক স্থানে পঞ্চম হিজরীর শাবান মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে পরাজিত হলে ছয়শত যুদ্ধবন্ধী, দুই হাজার উট ও পাঁচ হাজার ছাগল মুসলমানদের হাতে আসে। যুদ্ধবন্ধী হিসাবে হারেসের কন্যা জুয়াইরিয়াকে মদীনায় এনে তৎকালীন প্রচলিত নিয়মানুসারে বিলি বন্টন কালে গোলাম হিসাবে তাঁকে সাবিত ইবনে কায়েসের ভাগে দেয়া হয়। তারপর মুক্তি পণ দিয়ে মুক্ত করার পর হয়রত মোহাম্মদ (সাঃ) তাকে বিয়ে করেন। এতে শক্র ভাবাপন্ন দুই গোত্রের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়।
হযরত জুয়াইরিয়া আযওয়াজে মুতাহহারাতে (রাঃ) সামিল হওয়ার পর সাংসারিক কাজ শেষে ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকতেন। হিজরীর ৫০ সালের রবিউল আউয়াল মাসে এই মহিয়সী ৬৫ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফন করা হয়।

৯। উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান (রাঃ):-
হযরত উম্মে হাবীবার ডাক নাম রামালাহ। মুসলমান হওয়ার পর আবিসিনিয়ায় হিজরত কালে তার মেয়ে হাবীবা জন্ম হয়। তখন থেকেই তিনি উম্মে হাবিবা নামে অভিহিত হন। তিনি ছিলেন ইসলামের চির শক্র আবু সুফিয়ানের কন্যা।
আবিসিনিয়ার প্রবাস জীবনে স্বামী মদ্য পানে আসক্ত এবং খৃষ্টান ধর্মে দিক্ষিত হয়ে গেলে উম্মে হাবীবা বড় নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ষষ্ঠ বা সপ্তম হিজরীতে ৩৬/৩৭ বৎসর বয়সে তাঁর সাথে নবী করিম (সাঃ) ৪০০ দিনার মোহর আদায় করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই বিবাহের ফলে পিতা আবু সুফিয়ানের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। তিনি আস্তে আস্তে ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হতে থাকেন। অবশেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন।
আল্লাহর প্রতি তাঁর ভয় ছিলো অত্যন্ত প্রগাঢ়। তিনি সাড়া রাত ইবাদত-বন্দিগীতে কাটিয়ে দিতেন।
আমির মোয়াবিয়ার শাসন কালে ৪৪ হিজরীতে ৭৩ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মদীনায় তাঁকে দাফন করা হয়।

১০। হযরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতব (রাঃ):-
হযরত সাফিয়া (রাঃ) মদীনার বানু নাদীর নামক ইহুদী গোত্রে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হুয়াই বিন আখতব এবং মাতার নাম বাররা বিন শামাওয়াল। প্রথম স্বামী সালাম বিন মিশকাত আলকরজী এবং পিতা খায়বার যুদ্ধে নিহত হলে গনিমতের মাল হিসাবে গণ্য হন। এ সব মালামাল বন্টন কালে অন্যতম সাহাবী দাহইয়া আল কালবী রাসুলে করিম (সাঃ)- এর কাছে একজন দাসীর জন্য আবেদন করেন। মহানবী (সাঃ) তাঁকে দাসী বেছে নিতে সুযোগ দিলে তিনি সফিয়াকে নির্বাচন করেন। কিন্তু সফিয়া তার বংশ মর্যাদার কারণে একজন সাহাবীর ঘরে যেতে অস্বীকার করেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করায় স্বজাতির কাছে ফিরে যাওয়ার সমস্ত পথও তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি রাসুলে করিম (সাঃ)- এর দাসী হয়ে থাকার ইচছা ব্যক্ত করেন। শেষে তাই হলো। রাসুল তাঁকে বিবাহ করেন এবং পূর্বের নাম যায়নাব এর পরিবর্তে সাফিয়া রাখেন।
তিনি অত্যন্ত নম্র ও ধৈর্য্যশীলা চরিত্রের মহিলা ছিলেন। মহানবীর পতœী হিসাবে গৃহে পদার্পন কালে তিনি হযরত ফাতিমা ও রাসুলে পাকের অন্যান্য স্ত্রীদেরকে স্বর্ণালঙ্কার দান করে মধুর সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর কাছে থেকে কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
হযরত সাফিয়া ৫০ হিজরীতে ৬০ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করলে জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

১১। হযরত রেহানা বিনতে শামুন (রাঃ):-
রেহানা বিনতে শামুন ছিলেন সু-প্রসিদ্ধ ইহুদী বানু নাজীর গোত্রের মেয়ে। প্রথম স্বামী বানু কুরাইযা গোত্রের হামাকের মৃত্যুর পর যুদ্ধবন্ধী হিসাবে নিয়ে এলে কায়েসের কন্যা উম্মুর মুনজারের কাছে তাঁকে রাখা হয়। রেহানা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার পর আল্লাহর রাসুল ইহুদী গোত্রগুলির সাথে সু-স¤পর্ক প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ৪০০ দিরহাম মোহরানা প্রদান করে তাঁকে বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ করেন।
ঐতিহাসিকদের মতে রেহানা বিনতে শামুন রাসুলের (সাঃ) ইন্তেকালের ১০ বৎসর পূর্বে মৃত্যু বরণ করেন।

১২। হযরত ময়মুনা বিনতে হারিস (রাঃ):-
তিনি ছিলেন কুরাইশ গোত্রের আল হারিসের কন্য এবং রাসুলের চাচা আব্বাসের (রাঃ) শ্যালিকা। সপ্তম হিজরীর জিলকদ মাসে “ওমরায়ে কাযা” শেষ করার পর এবং সঠিক কথা অনুযায়ী এহরাম থেকে হালাল হওয়ার পর রাসুলে পাক (সাঃ) ৫০০ দিরহাম মোহরানা ধার্য করে তাঁকে বিয়ে করেন। তখন মায়মুনার বয়স ছিলো ৫১ বৎসর।
মায়মুনা অত্যন্ত ধর্ম ভীরু ছিলেন। তার কাছে থেকে ৪৬টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা মায়মুনা স¤পর্কে বলেন, “মায়মুনা আল্লাহকে অনেক ভয় করতেন এবং অপরের কল্যাণ করতেন।”
মায়মুনা (রাঃ) ৬১/৬৮১ সনে সারিফে ইন্তেকাল করেন। যে স্থানে বিবাহ হয়েছিলো, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।
দাসীদের স¤পর্কেও এখানে আলাপ করা প্রয়োজন।
রাসুলে পাকের চারজন দাসীর মধ্যে দু’জনই ছিলেন প্রধান। তাঁদের মধ্যে মারিয়া কিবতিয়াকে মিশরের শাসন কর্তা মোকাওকিস উপটৌকন হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর গর্ভেই ইব্রাহীম নামে রাসুলে পাকের এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহন করেন। পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি মাত্র পাঁচ বৎসর বেঁচে ছিলেন। যদিও মারিয়া কিবতিয়াতে হযরত বিবাহ করেননি তবু তাঁকে স্ত্রীর সম মর্যদা দান করা হয় এবং মৃত্যুর পর তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।
অন্য আর একজনের নাম ছিলো রায়হানা । তিনি বনু নাজির বা কোরায়যা গোত্রের অšর্তভূক্ত। বনু কোরায়যা গোত্রের যুদ্ধ বন্ধীদের সাথে তিনি মদীনায় আসেন। রাসুলে পাক তাঁকে পছন্দ করে মুক্তি দানের পর নিজ নিয়ন্ত্রনে রাখেন।
আর দু’জন দাসীর মধ্যে একজনের নাম ছিলো জামিলা। অন্য একজনের নাম জানা যায় না। তবে তাকে নবী করিম (সাঃ) হরযত জয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ)- এর কাছে হেবা করে দেন।
অসীম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ পাকের কুদ্রত ও হিকমত জানা এবং বুঝার সাধ্য কারো নাই, যদি তিনি দয়া করে কাউকে সে সব বুঝার ক্ষমতা সেই ব্যক্তির অন্তরে পয়দা করে না দেন।
আল্লাহ পাক হেদায়েতের জন্য নবী ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর পবিত্র কালাম পাঠিয়ে মানুষের করনীয় কার্য সমূহ এবং তার ভাল মন্দ বুঝার জ্ঞান দান করেছেন। এ ছাড়া সময় উপযোগী আরও অনেক কিছুই পবিত্র ও বিশেষ তরিকায় হিকমত বা কৌশলের মাধ্যমে অবতারণা করেছেন তাঁর প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সাঃ) কে দিয়ে। এদের মধ্যে অন্যতম হিকমত হচেছ এই বিবাহ বন্ধন।
তখন আরবে গোত্রে গোত্রে মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া ফ্যসাদ, রাহাজানি, কুসংস্কারে ভরপুর ছিলো। এসব দূরীকরণে এবং গোত্রে গোত্রে সৌহার্দ্য ভাব স্থাপনের জন্যই রাসুলে করিম এই সব বিবাহ করেছিলেন। যুদ্ধ ও জ্বেহাদের পাশাপাশি এটা ছিলো আর এক ধরণের ভ্রতৃত্ববোধ তৈরীর মহান কাজ।
আমাদের প্রিয় নবী মোহে পড়ে কাউকে বিবাহ করেছে এমন কোন প্রমাণ নেই। আর এটা হতে পারে না। যাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন তার চরিত্রে জাগতিক লোভ, লালসা বা মোহ ইতাদি থাকা একদম অসম্ভব।
তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি পঁচিশ বৎসর বয়সে চল্লিশ বৎসর বয়সী কয়েক সন্তানের মাতা এক বৃদ্ধাকে বিবাহ করেন। এবং যৌবনের প্রায় ২৭টি বৎসর তাঁর সঙ্গে সুখে শান্তিতে অতিবাহিত করেন।
তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যাকে বিবাহ করেন তিনিও ছিলেন একজন বিধবা নারী। তারপর বিবাহ করেন এমন একজনকে যার বয়স ছিলো মাত্র ছয় বৎসর। হিজরতের সাত মাস পরে এই নয় বৎসর বয়সী বালিকা স্বামীর গৃহে পদার্পণ করেন। এরপর ক্রমান্বয়ে যারা তাঁর জীবন সঙ্গিনী হয়ে আসেন তারা সবাই ছিলেন বিধবা। সাধারণতঃ বিবাহ করার যে উদ্দেশ্য, নবী করিম (সাঃ)- এর বিবাহের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। তাঁর বিবাহ করার উদ্দেশ্য ছিলো অনেক মহৎ ও তাৎপর্যপূর্ণ।
(চলবে………………)

Related posts

Leave a Comment