ডাঃ মৌলভী কাজী আবদুর রহমান
পর্ব-নয়
রাসুল পাক (সাঃ)- এর অধিক বিবাহের উদ্দেশ্য
আল্লাহ পাক বলেছেন-
“নবী মোহাম্মদ (সাঃ) নিজ থেকে কিছুই করেন না, যা করেন আমার নির্দেশেই করেন।”
জগৎবাসীর পথ প্রদর্শক আল্লাহর প্রেরীত রাসুল সাইয়েদুল মোরছালীন রাহতুল্লিল আলামীন হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)- এর বহু বিবাহের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এখানে যৎ সামান্য আলোকপাত করা হলো।
হযরত রাসুলে করিম (সাঃ) হযরত আয়েশা ও হযরত হাফসা (রাঃ)- কে বিবাহ করে হয়রত আবু বকর এবং হযরত ওমরের (রাঃ) সঙ্গে সু-সম্পর্ক তৈরী করেছিলেন। এ ভাবে হযরত ওসমানের (রাঃ) কাছে পরপর দুই কন্যা এবং হযরত আলীর (রাঃ) সাথে প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাকে বিয়ে দিয়ে উল্লেখিত চারজন সাহাবীর মধ্য ঘনিষ্ট আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি করেন। যার ফলশ্রুতিতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)- এর ওফাতের পর ইসলামের এক ক্রান্তি লগ্নে এরা কখনো সম্মলিত ভাবে আবার কখনো একক ভাবে অতুলনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিচয় দিয়েছিলেন। ঐ সময় তাঁদের এই ভূমিকা ইসলামের জন্য শুধু প্রয়োজনই ছিলো না বরং অপরিহার্য ছিলো।
আরবের নিয়ম অনুসারে আত্মীয়তার বন্ধনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হতো। আরবদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে ‘জামাতা’ বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। জামাতার সাথে যুদ্ধ করা ছিলো- অত্যন্ত লজ্জাজনক কাজ। এই নিয়মের কারণে রাসুলে করিম (সাঃ) বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করে ইসলামের শত্রুকে মিত্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ গড়ে তোলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হযরত উম্মে সালমা ছিলেন বনু মাখযুম গোত্রের মেয়ে। এই গোত্রের লোক ছিলো আবু জেহেল এবং খালেদ বিন ওয়ালীদ।
এই গোত্রের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে ইসলামের প্রতি পূর্বের তেমন প্রবল শত্রুতা পোষণ করতে দেখা যেতো না। বরং কিছুকাল পর তিনি নিজেই স্বেচছায় ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহন করেন। অপর দিকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হবীবাকে বিবাহ করার পর আবু সুফিয়ান ইসলামের শত্রুতা করলেও কখনও রাসুলুল্লাহর সামনে আসেন নাই। হযরত যোয়াইরিয়া (রাঃ) ও হযরত সফিয়া বিনতে হুয়াই (রাঃ) নবী (সাঃ)- এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর বনু মুস্তালেক এবং বনু নাযির গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছেড়ে দেন। বিবাহের পর এই দুই গোত্র রাসুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।
হযরত যোয়াইরিয়া তো তাঁর গোত্রের জন্য সকল মহিলার চেয়ে অধিক বরকত সম্পন্না বলে বিবেচিত। প্রিয় নবী (সাঃ) বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামগণ উক্ত গোত্রের একশত যুদ্ধবন্ধীকে বিনা শর্তে মুক্তি দেন। তারা বলেছিলেন, এরা তো রাসুলের শ্বশুর পক্ষের লোক। পরে গোত্রের লোকদের মধ্যে এই সহানুভূতির প্রতিক্রিয়া দারুণ ভাবে প্রভাব ফেলেছিলো। সবচেয়ে বড় কথা, রাসুলে পাক (সাঃ) একটি উশৃঙ্খল জাতিকে প্রশিক্ষণ ও তাদের মানসিক পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা করে সভ্যতা ও সাংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ওরা ছিলো সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সমাজের বিকাশ সম্পর্কিত দায় দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। যে সকল নীতিমালার ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার ছিলো তার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ ভেদাভেদ করার কোন সুযোগ ছিলো না। কিন্তু ভেদাভেদ মুক্ত চিন্তা ধারার আলোকে মহিলাদের সরাসরি শিক্ষা দেয়াও সম্ভব ছিলো না। অথচ তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কোন অংশেই পুরুষদের চাইতে কম ছিলো না বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেশীই ছিলো।
এ ব্যাপারে রাসুলে পাকের সামনে খোলা ছিলো একটি মাত্র পথ, আর তা হচেছ- বিভিন্ন বয়স ও যোগ্য মহিলাদের মনোনীত করে তাদের মেধা ও যোগ্যতানুসারে শিক্ষা দিয়ে তার মানসিক পরিশুদ্ধিতা ঘটানো। যারা শরীয়তের হুকুম আহকাম অন্যান্য মানুষকে শেখাবেন। এ ছাড়া তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এমন ভাবে শিক্ষা দেবেন যাতে তারা গ্রাম ও শহরের যুবতী বৃদ্ধা নির্বিশেষে সকল মহিলাদের শরীয়তের বিধি-বিধান শেখাতে পারেন। এর ফলে তাদের মধ্যে তবলীগে দ্বীনের দায়িত্ব পূর্ণতা লাভ করবে।
এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করি, দাম্পত্য জীবনে তথা পারিবারিক জীবনের রীতি-নীতি ও বিধি নিষেধ শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে উম্মুল মোমেনীনরা বিরাট ভূমিকা পালন করেন। বিশেষতঃ যারা দীর্ঘায়ুু হয়েছিলেন তারা এ দায়িত্ব পালনের সুযোগ বেশী পান। উদাহরণ স্বরূপ আমরা হযরত আয়েশা সিদ্দিকার (রাঃ) কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনি নবী জীবনের অনেক কথা ও কাজের বর্ণনা ব্যাপক ভাবে উল্লেখ করেছেন।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একটি বিষয়ে জাহেলী যুগের রীতি-নীতি চির দিনের মতো নস্যাৎ করে দেন। নিয়ম ছিলো, পালক পুত্র হিসাবে কাউকে গ্রহণ করা হলে সে আসল পুত্রের মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করতো। এই নিয়মে সমাজে এমন দৃঢ় ভাবে প্রোথিত হয়ে বসেছিলো যে, তা বিলোপ করা মোটেই সহজ সাধ্য ছিলো না। অথচ এই নিয়ম ছিলো ইসলামের বিয়ে, তালাক, সম্পত্তি আইন এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে মারাÍক সংঘাতপূর্ণ। এ ছাড়া জাহেলী যুগের এই কুসংস্কার এমন সব নির্লজ্জ কার্য্যকলাপ এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিলো যে, এ থেকে সমাজ দেহকে মুক্ত করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। আর জাহেলী যুগের এই কুসংস্কার নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসুলে করিম (সাঃ)- এর সাথে হযরত জয়নব বিনতে জাহাশের (রাঃ) বিয়ে দেন।
হযরত রাসুলে পাক (সাঃ)- এর সন্তানগণ
এবং সৈয়দ বংশের পরিচয়
রাসুলে পাকের ৪ ছেলে এবং ৪ মেয়ে ছিলেন। এদের মধ্যে হযরত খাদিজাতুল কোবরার (রাঃ) গর্ভে ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। ছেলেরা হলেন- ১। কাশেম ২। তৈয়ব ও ৩। তাহের এবং মেয়েরা হলেন- ১। জয়নব ২। রোকেয়া ৩। উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা। ইব্রাহীম নামে এক ছেলে বিবি মারিয়া কিবতীয়ার গর্ভে জন্ম গ্রহন করেন।
ছেলেরা সবাই শৈশব কালেই ইন্তেকাল করে। আর মেয়েরা পরিণত বয়সে বিবাহের পর ইন্তেকাল করেন। তন্মধ্যে বুজুর্গ কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা জোহরা (রাঃ)- এর বংশধরগণই সৈয়দ (বা সরদার) নামে দুনিয়ায় পরিচিত।