মোঃ শফিকুল ইসলাম দুলাল,ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ
ছেলের অভিযোগে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁকে ডেকে নিয়ে যান নিজের কার্যালয়ে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজের জমি বিক্রি করে হাজার হাজার তালগাছ রোপণ করছেন রাস্তার ধারে। নিজের গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলার বিভিন্ন রাস্তা ছাড়িয়ে পাশের উপজেলারও বিভিন্ন রাস্তার ধারে তিনি তালগাছ লাগিয়েছেন। সেগুলোর বীজ সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেদার অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সে অর্থের জোগান দিতে প্রতিবছর বিক্রি করতে হচ্ছে নিজের কৃষিজমি। পুত্ররা উদ্বিগ্ন ও নিরুপায় হয়ে অভিযোগ করেছেন থানায়। সব শুনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়েছেন ফুলের মালা। পুত্রদের পক্ষ নিয়ে করজোড়ে অনুরোধ করেছেন জমি বিক্রি না করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ৮০ বছর বয়সী খোরশেদ আলম সব অনুরোধ উপেক্ষা করে তালগাছ রোপণ ও পরিচর্যা করেই চলেছেন এখনো। খোরশেদ আলমের জমি বিক্রির বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার উপজেলা আইন শৃংখলা সভায় আলোচনা করা হয় এবং তাকে সহযোগিতা করার জন্য সকল চেয়ারম্যান মেম্বারদের আহবান জানানো হয়।
সম্প্রতি এক সকালে খোরশেদ আলমের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মনে পড়ল বিহারের দশরথ মাঝির কথা। তাঁর গল্প মনে থাকতে পারে অনেকের। ২২ বছর ধরে গাঁইতি-শাবল দিয়ে দশরথ একাই পাহাড় কুঁদে তৈরি করেছিলেন ৩৬০ ফুট দীর্ঘ ও ৩০ ফুট প্রশস্ত সড়ক। এর জন্য নিজের গ্রাম থেকে পাহাড় ঘুরে হাসপাতালে যেতে পাড়ি দিতে হতো যে ৫৫ কিলোমিটার পথ, তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১৫ কিলোমিটারে! ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত হয়ে চলা পরিবেশের হাত থেকে বাঁচাতে ঠাকুরগাঁওয়ের খোরশেদও শুরু করেছেন তালগাছ রোপণ ও পরিচর্যা করে বড় করে তোলার এক কঠিন যুদ্ধ।
খোরশেদ আলমের বাড়ি পাথুরে পাহাড়ের দেশে নয়। তবে তাঁর গ্রামের নাম পাহাড়ভাঙ্গা। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নে এ গ্রাম। পেশায় তিনি একজন পল্লিচিকিৎসক। নিজের কৃষিজমি আর গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করে পাওয়া অর্থে চলে তাঁর সংসার। এ জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ১০ বছর ধরে রাস্তার ধারে তালগাছ লাগিয়ে চলেছেন তিনি। শুধু পরিবেশ রক্ষা করাই তাঁর উদ্দেশ্য নয়। খোরশেদ আলম মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের স্মরণেও করছেন এ কাজটি। এ জন্য তিনি ১ লাখ তালগাছের চারা রোপণ করতে চান রাস্তার ধারে। তিনি মনে করেন, তালগাছগুলো একদিকে পরিবেশ বাঁচাবে এবং বজ্রপাত ঠেকাতে সহায়তা করবে। অন্যদিকে এই ১ লাখ গাছ দেখলে মানুষের মনে পড়বে, এ দেশ মুক্ত করতে শহীদ হয়েছিলেন ৩০ লাখ মানুষ। এ লক্ষে তিনি এগিয়ে গেছেন অনেকখানি। ইতিমধ্যে রোপণ করেছেন প্রায় ৬০ হাজার তালগাছের চারা!
খোরশেদ আলমের ছেলে আবদুল মতিন। বাবার এ কাজে তিনি ক্ষুদ্ধ নন। কিন্তু জমি বিক্রির বিষয়ে উদ্বিগ্ন। মতিন জানিয়েছেন, তাঁর বাবা টাকা দিয়ে যেমন তালগাছের বীজ কেনেন, তেমনি মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরেও বীজ সংগ্রহ করেন। সেসব তালবীজ তিনি গ্রামের রাস্তার পাশে, রেললাইনের ধারে লাগিয়েছেন।
পাহাড়ভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, খোরশেদ আলমের এই বৃক্ষপ্রেম লোকদেখানো নয়, ‘জেনুইন’। গ্রামের সাইমুম ইসলাম জানান, খোরশেদ শুধু গাছ লাগিয়েই কাজ শেষ করছেন না। প্রতিদিন মোটরসাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে গাছ দেখাশোনা ও পরিচর্যার কাজ করেন তিনি। তবে পরিচর্যার কাজটি থেকে তাঁকে মুক্ত করতে কাজ করছেন চিলারং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক। তিনি জানিয়েছেন, খোরশেদ আলমের রোপণ করা তালগাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি ইউপি কার্যালয় থেকে দেখা হচ্ছে।