শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে এবং এ ব্যাপারে তাদের কোনো প্রকার ছাড় দেয়ার মানোভাব দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আর মাত্র ছয় মাসের মতো সময় বাকি থাকতে দুই প্রধান দলের মধ্যে এই অনাস্থা ও বিরোধপূর্ণ অবস্থান রাজনীতিতে সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সবশেষ বুধবারও আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আরো একবার দলের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একই দিনে বিএনপি আয়োজিত এক সেমিনারে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন আন্দোলনের মাধ্যমে এবার নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করা হবে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্তমান সরকারের পদত্যাগ দাবি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। তবে সরকারি দল বলছে এই দাবি মানার কোনো সুযোগ নেই এবং সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনঢ় অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমঝোতার হবে কিনা বা দলগুলো একে অপরকে কোনো ছাড় দেবে কিনা সেটি স্পষ্ট হচ্ছে না। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও তাদের দলীয় অবস্থানের পেছনে যুক্তি তুলে ধরছেন, যেখানে সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত মিলছে না।
আইনি বিকল্প কী আছে?
আওয়ামী লীগের আন্দোলন ও দাবির মুখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ২০১১ সালে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
বর্তমানে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। কিন্তু আইনের মধ্যে থেকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দুটি বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। একটি সর্বদলীয় সরকার এবং আরেকটি হচ্ছে সরকার প্রধানের পদত্যাগ।
‘আওয়ামী লীগের যারা মন্ত্রী আছেন, ধরেন পঞ্চাশ জনের মতো, এটাকে কমিয়ে ১০-১২ জনের মন্ত্রিসভা করতে পারে। কিন্তু ওই মন্ত্রিসভার সদস্য হতে হবে সংসদ সদস্যদের। তর্কের খাতির যদি ২০ জনের ছোট মন্ত্রিসভা হলো এবং দুজন টেকনোক্র্যাট নেয়া যায় এবং তাদের নিয়ে ধরেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো।’
‘আরেকটা অপশন হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেন কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগেরই অন্য কোনো সংসদ সদস্য তখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন,’ বলেন শাহদীন মালিক।
বর্তমান সংবিধানে সপ্তম ভাগে ১২৩ অনুচ্ছেদে নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটি বিষয় উল্লেখ রয়েছে। যেটি হলো- ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।’
শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানে নির্বাচনের সময় সংক্রান্ত দুটো বিধান আছে। একটা হলো সংসদ ভেঙে দিলে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেশে রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দিতে পারেন।
‘সংসদ ভেঙে দিলে ভেঙে যাওয়া দিন থেকে তখন হবে কি যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তারা আর আসনে থাকবেন না এবং ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গত ২০১৪ এবং ১৮’র নির্বাচনে কিন্তু সংসদ রেখে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙে দিলে বিরোধীরা কিছুটা হয়তো সমতার ব্যাপারটা চলে আসবে। সরকারি দলের বা যেই নির্বাচন করুক কেউই সংসদ সদস্য না। তখন কিছুটা হয়তো ফেয়ার প্লে হবে।’
তবে বর্তমান সংবিধান সমুন্নত রেখে আইনের মধ্যে থেকে সংসদ ভেঙে দেয়া বা নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে টেকনোক্র্যাট হিসেবে বিরোধী দলকে নেয়া বা শেখ হাসিনার পদত্যাগের মতো বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য হবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক।
বিএনপির অবস্থান
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকারের অধীনে সব ধরনের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে, উপনির্বাচন কোথাও দলীয় প্রার্থী দিচ্ছে না দলটি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একদিকে রাজপথে আন্দোলন করছে আবার সভা-সেমিনার করে দেশী-বিদেশী জনমত গঠনেও রয়েছে সচেষ্ট দলটি।
বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচকালীন সরকারের যে বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে সেটিও বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ে পরবর্তী আরো দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ ছিল। তাই সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাই করতে হবে।
বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘আমরা তো এটা স্পষ্ট ইতোমধ্যে করে দিয়েছি। বর্তমান যে সরকার, এই সরকার যদি ক্ষমতায় থেকে তারা একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে সেই নির্বাচন কোনোদিন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারবে না।’
‘সংবিধান অনুযায়ী করতে গেলে মেজরিটি যে পার্টি আছে তাদের দলের যিনি নেতা বা নেত্রী তিনি সরকারপ্রধান হবেন। কাজেই সংবিধান যদি আমরা অন্ধভাবে অনুসরণ করতে যাই তাহলে তো আমাদের মুক্তি নেই।’
মঈন খান বলেন, ‘এমন একটা সিস্টেম তৈরি হয়েছে যার মাধ্যমে এদেশে গণতন্ত্র কোনোদিন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কাজে এখানে ব্যক্তিটা মুখ্য উদ্দেশ্য বলে আমি মনে করি না। এখানে এই সিস্টেমটা পরিবর্তন করতে হবে। এবং এই সিস্টেমটা পরিবর্তন করতে হলে বর্তমান যে সেটআপ যেটা আছে সেটাকে বিদায় নিতে হবে।’
বিএনপি মনে করে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দলটির সুস্পষ্ট অবস্থান হলো, যে নামেই হোক নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠনের ব্যবস্থা সৃষ্টি। এক্ষেত্রে এবার কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় দলটি।
বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করে দলের সিনিয়র নেতা মঈন খান বলেন, সংবিধান সংশোধন করেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ছাড়া কোনো বিকল্প দেখছে না বিএনপি।
‘দেশের মানুষ তো সংবিধানের জন্য নয়, সংবিধান দেশের জন্য। কাজেই দেশের মানুষ যেভাবে চাইবে, দেশের মানুষ যদি তাদের অধিকারটি তারা পুনরুদ্ধার করতে চায় এবং সেজন্য যদি সংবিধানের পরিবর্তন করতে হয়, লঙ্ঘন করতে হয়, আমি তো তাতে কোনো অপরাধ দেখি না।’
‘এ কথাটি আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই- মানুষের যে অধিকার, জনগণের যে অধিকার সেটাই হচ্ছে সর্বাগ্রে। এটা তো কোনো বাইবেল নয় যে এটা পরিবর্তন করা যাবে না।’
মঈন খান বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান বার বার পরিবির্তিত হয়েছে বার বার লঙ্ঘিত হয়েছে। কাজেই সংবিধান লঙ্ঘন হবে তার দোহাই দিয়ে মানুষের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখা এটা কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনো কথা নয়।’
আওয়ামী লীগ কি ছাড় দেবে?
নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা ছোট-বড় করা সহজভাবে দেখা হলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প কাউকে চিন্তাও করে না। আর ভোটের রাজনীতির বিবেচনা থেকেই কোনো পরিস্থিতিতেই বিএনপির দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিএনপির দাবির ব্যাপারে বলেন, ‘অসম্ভব। এটা যদি হয় তাহলে আওয়ামী লীগ প্রথমেই ডিফিট খাবে। তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচন করে তো কোনো লাভ নাই। আন্দোলনের কাছে যদি কোনো দল নতি শিকার করে সেই দল তো থাকে না।’
তোফায়েল আহমেদ দৃঢ়তার সাথে বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
‘মন্ত্রিসভা ছোট করা, বড় করা সেটা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। এটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এক কথায় বলতে গেলে নির্বাচনটা সংবিধান অনুসারেই অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে, যারা নির্দলীয় সরকার চায় এটা কোনোদিনই সম্ভব হবে না। কারণ এই চ্যাপ্টার চিরদিনের জন্য ক্লোজড।’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন এবং কোনো চাপ নিয়েও চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ।
‘কেউ যদি মনে করে যে চাপ দিয়ে আন্দোলন করে এই সরকারকে পরিবর্তন ঘটিয়ে নির্বাচন করবে সেটা বাস্তবসম্মত না এবং সেটা সম্ভবও না। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাই থাকবে। তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।’
বিএনপির আন্দোলন এবং রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন হবেই। নির্বাচনকে ঠেকাবার ক্ষমতা কারো নাই। আর চাপের কাছে মাথানত করার মতো দল আওয়ামী লীগ না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা, তিনি বঙ্গবন্ধুর মতোই দৃঢ় এবং যেটা সিদ্ধান্ত নেন সেটা তিনি করেন।’
সূত্র : বিবিসি