– ডাঃ মৌলভী কাজী আবদুর রহমান
ঈমানের রোকন
ঈমানের রোকন ৩ প্রকার। যথা:-
ক) একরার বিল লিছান
খ) তাসদিক বিল জিনান
গ)আমল বিল আরকান।
ক) একরার বিল লিছান:– মুখে বলা বা উচচারণ করা, অন্তরে স্বীকার করা এবং জবানে ঘোষণা দেয়াকে একরার বিল লিছান বলা হয়।
খ) তাসদিক বিল জিনান:- অন্তরে এমন বিশ্বাস আনয়ন করা, এমন একীন স্থাপন করা যে বান্দার সব কিছুর মালিক এক আল্লাহ এবং তাঁর যাবতীয় হুকুম বিনা দ্বিধায় পালন করাই বান্দার আসল কতব্য। এমন কি জীবনের এক মূহুর্ত সময়ও তাঁর হুকুমের, তার নির্দেশের বাইরে অতিবাহিত কারর অধিকার বান্দার নেই। এটাই তাসদিক বিল জিনান।
গ) আমল বিল আরকান:- আল্লাহ পাকের নির্দেশিত সকল হুকুম আহকামগুলি সঠিক ভাবে জেনে, বুঝে, ইসলামী আকীদায় এবং নবী করীম (সাঃ) এর তরীকায়, অতি শ্রদ্ধা সাথে, নিখুঁত ও নির্ভেজাল ভাবে পালন করার নামই আমর বিল আরকান।
ঈমানের ৭৭ টি শাখার বর্ণনা
আল্লামা নব্বী (রঃ) বলেছেন-
“হাদীস শরীফে কালেমাকে ঈমানের মূল বলা হয়েছে। কাজেই আল্লাহকে ভালবেসে এবং এই পবিত্র কালেমার আসল উদ্দেশ্য অন্তরে উপলব্দি করে এটি শিক্ষা গ্রহন করা এবং নিজের জিন্দেগীতে বা বাস্তবায়ন করা উচিত।”
৩টি বস্তু একত্রে পাওয়া এবং থাকার নামই ঈমান। এ ছাড়া বাকী শাখা সমূহ সম্বন্ধেও মোটামুটি ধারণা রাখা কর্তব্য। এগুলো ইসলামের আকিদা নামে পরিচিত। বিষয়গুলো হলোঃ-
১। ধর্মীয় সকল বিষয়ের প্রতি অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করা।
২। মুখে স্বীকার করা।
৩। শরীরের দ্বারা এ কাজগুলো পালন করা বা আমল করা।
এই বিষয়টির মধ্যে সমস্ত মুসলমানের আকায়েদ শামিল রয়েছে, যা ৩০ প্রকার। যথা:-
১) প্রথম আল্লাহ পাকের উপর ঈমান আনা। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের জাত এবং সেফাত অর্থাৎ গুণাবলীর সব কিছুই শামিল রয়েছে। এই ভাবে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক এবং তুলনা নাই।
২) একমাত্র আল্লাহই চিরন্তন, চিরঞ্জীবি ও চিরস্থায়ী। তিনি অমর। তিনি ব্যতীত যা কিছু আছে বা হবে, সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং ধ্বংসশীল।
৩) ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান আনা।
৪) আসমানী কিতাব সমূহের প্রতি ঈমান আনা।
৫) পয়গম্বরগণের (আঃ) প্রতি ঈমান আনা।
৬) তকদিরের ভাল মন্দের প্রতি ঈমান আনা।
৭) কিয়ামতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, যার মধ্যে কবরের সওয়াল জওয়াব, কবরের আযাব, মৃত্যুর পর জিন্দা হওয়া, হিসাব নিকাশ, মিজানের পাল্লায় নেকী ও বদীর সূক্ষ্ম ওজন করা, পুলছিরাত পার হওয়া ইত্যাদি সব কিছুর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।
৮) বেহেশতের প্রতি একীন বা বিশ্বাস স্থাপন করা। সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে আল্লাহকে বিশ্বাসী বান্দাগণ অনন্তকাল সেখানে আল্লাহর নেয়ামত ভোগ করবে, পরম সুখে থাকবে।
৯) জাহান্নামের উপর একীন করা যে, এটা কঠিন আযাবের স্থান। আল্লাহর নাফরমান বান্দাগণ এ সকল আযাব ভোগ করবে।
১০) আল্লাহ পাকের সাথে খাঁটি মহব্বত রাখা।
১১) শুধু আল্লাহর জন্যই কারো সাথে মহব্বত রাখা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারও সাথে দুশমনী করা। ছাহাবায়ে কেরাম বিশেষতঃ আনছার ও মোহাজেরীন এবং নবীয়ে করীম (সাঃ)- এর বংশদরগণের প্রতি মহব্বত রাখাও এর অন্তর্ভূক্ত।
১২) হুজুরের সাথে মহব্বত রাখা। হুজুরের সম্মানে তার উপর দরূদ পড়া, তার সুন্নতের অনুসরণ এবং অনুকরণ করা।
১৩) এখলাছ অর্থাৎ রিয়াকারী এবং মোনাফেকী হতে বেঁচে থাকা।
১৪) তওবা, অর্থাৎ অন্যায় কৃত কর্মের উপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে গুনাহের কাজ না করার নিয়্যত করা (সংকল্প করা)
১৫) আল্লাহকে ভয় করা।
১৬) আল্লাহর মহব্বত লাভের আশা করা।
১৭) আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ না হওয়া।
১৮) আল্লাহর শোকর করা।
১৯) ওয়াদা করলে তা পূরণ করা।
২০) ছবর করা।
২১) বিনয়ী হওয়া, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকা।
২৪) তাওয়াক্কুল অর্থাৎ আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া।
২৫) আÍ প্রশংসা না করা (নফসের এসলাহ করাও এর মধ্যে সামিল)।
২৬) হিংসা বিদ্বেষ না করা।
২৭) লজ্জা করা।
২৮) রাগ না করা।
২৯) ধোঁকাবাজী ও প্রবঞ্চনা না করা এবং কার ও প্রতি কু-ধারণা পোষণ না করা।
৩০) দুনিয়ার মহব্বত অন্তর হতে দূর করা, ধন-দৌলত ও মান ইজ্জতের লোভ না করা। আল্লামা আইনি বলেছেন-
“উল্লেখিত বিষয় সমুহ অন্তরের আমলের মধ্যে গণ্য। বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনটা বাইরের মনে করলেও প্রকৃত পক্ষে উহা দীলেরই আমল।”
জবানের আমল ৭ প্রকার। যথা:-
(১) কালেমা ত্যাইয়েবা পড়া।
(২) কোরআন পাক তেলোয়াত করা।
(৩) এলমেদ্বীন শিক্ষা করা।
(৪) অন্যকে এলেম শিক্ষা দেয়া।
(৫) দোয়া করা।
(৬) আল্লাহ পাকের যিকির করা।
(৭) লা-ইয়ানী অর্থাৎ অনর্থক (বেহুদা) কথাবার্তা না বলা।
শরীরের অমল ৪০ প্রকার। এটা আবার তিন ভাগে বিভক্ত।
প্রথম ভাগ:-
এটা নিজের সাথে সম্পর্ক যুক্ত এবং ষোল ভাগে বিভক্ত। যথা:-
(১) পবিত্রতা হাসিল করা। এতে শরীরের পবিত্রতা অর্থাৎ অজু, গোছল, হয়েজ, নেফাছ ও অন্যান্য নাপাকী হতে পাক হওয়া এবং কাপড় পবিত্র রাখা, ঘর দরজা পবিত্র রাখা।
(২) নামাজের পাবন্দী করা, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল আদায় করা।
(৩) ছদকা, যাকাত, ফিতরা, দান-খয়রাত, মানুষকে খানা খাওয়ানো (মেহমানদারী করা), গোলাম আযাদ করা।
(৪) রোজা রাখা (ফরজ হোক বা নফলই হোক)
(৫) হজ্জ করা- এটা ফরজ, নফল ওমরা পালন বা তওয়াফ করা, যাই হোক না কেন সবই এর মধ্যে পড়ে।
(৬) এতেকাফ করা, শবে কদর তালাশ করা।
(৭) দ্বীনের হেফাজতের জন্য বাড়ী ঘর ত্যাগ করা, হিজরত করা।
(৮) মানত পুরা করা।
(৯) কছমের প্রতি দৃষ্টি রাখা।
(১০) কোন কাফফারা থাকলে আদায় করা।
(১১) নামাজের বাইরেও ছতর ঢেকে রাখা।
(১২) কোরবানী করা এবং কোরবানীর জানোয়ার সম্বন্ধে খবর দেয়া।
(১৩) জানাজা ও তার যাবতীয় কাজের ব্যবস্থা করা।
(১৪) কর্জ পরিশোধ করা।
(১৫) লেনদেনে সততা বজায় রাখা এবং সুদ ও ঘুষ হতে বেঁচে থাকা।
(১৬) সত্য কথার সাক্ষ্য দান করা, কোন কথা গোপন না করা ।
দ্বিতীয় পর্যায়:-
এটা আবার ৬ প্রকার। যথা:-
(১) বিবাহের দ্বারা হারাম কাজ হতে আÍরক্ষা করা।
(২) পরিবার পরিজনের হক আদায় করা, চাকর চাকরানীদের দাবী দাওয়া ঠিকমত আদায় করা।
(৩) মাতা পিতার প্রতি সৎ ব্যবহার করা, নম্রতা ও শ্রদ্ধা বজায় রাখা।
(৪) সন্তান সন্ততিগণের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা।
(৫) আÍীয় স্বজনের প্রতি সৎ স¤পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের প্রতি মহব্বত রাখা ও দয়া করা।
(৬) উপরওয়ালা পরিচালকের অনুগত হওয়া(যদি সে শরীয়ত মোতাবিক চলে)।
তৃতীয় পর্যায়:-
এ পর্যায়ে রয়েছে সাধারণ মানুষের হক। আর তা হলো ১৮ প্রকার। যথা ঃ-
১। ন্যায় বিচারের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
২। হক্কানী জামায়াতের সহযোগিতা করা।
৩। শরীয়ত বিরোধী কোন হুকুম না হলে শাসন কর্তার অনুসরণ করা।
৪। পার¯পরিক বিষয় সমূহের সংশোধন করা (মীমাংসা করা), জালেমদের শাস্তি দেয়া, বিদ্রোহীর সাথে জ্বেহাদ করা।
৫। নেক কাজে অন্যের সাহায্য করা।
৬। সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা, তবলীগ বা ওয়াজ করা।
৭। জ্বেহাদ করা (সীমান্ত রক্ষা করাও এর অর্ন্তভূক্ত)।
৮। হক কায়েম করা।
৯। আমানত আদায় করা, গণিমতের এক পঞ্চমাংশ প্রদান করা।
১০। কর্জ দেয়া বা আদায় করা।
১১। প্রতিবেশীর হক আদায় করা, তাদের সম্মান করা।
১২। দেনা-পাওনা আদান প্রদান যথাযথ ভাবে পালন করা। বৈধ উপায়ে ধন স¤পদ উপার্জন করা।
১৩। মাল ও দৌলত যথা স্থানে খরচ করা।
১৪। সালাম করা ও তার জবাব দেয়া।
১৫। হাঁচি দিলে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা।
১৬। নিজের কষ্ট হতে দুনিয়াকে রক্ষা করা।
১৭। খেলা তামাশা হতে বেঁচে থাকা।
১৮। রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেয়া।
প্রকৃত ঈমান হাসিল করতে গেলে উপরে উল্লেখিত ঈমানের ৭৭টি শাখা সম্বন্ধে ভালোভাবে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে ঈমানকে হেফাজত করতে হলে, মুসলমানিয়াত পুরাপুরি কায়েম করতে হলে, এক কথায় দ্বীনের উপর নিজকে কায়েম রাখতে চাইলে ঈমানের এ সকল বিষয়ে ভাল ভাবে জানা একান্ত দরকার। অর্থাৎ এলমে দ্বীন শিক্ষা গ্রহন করা একান্ত কর্তব্য। তা না হলে কারও পক্ষে আকীদা ঠিক রাখা কিছুতেই সম্ভব নয়। সব চাইতে বড় ভয় হলো, ঈমান নিয়ে দুনিয়া হতে বিধায় নেয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
(চলবে……………)