পুরস্কৃত হচ্ছেন বিতর্কিত সেই ওসি ডাবলু

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল হক ডাবলু। তার রাজনৈতিক আদর্শ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবুর কমিটির নির্বাহী সদস্য। এবারের পুলিশ সপ্তাহে তিনিই পাচ্ছেন পদক। অপরদিকে আওয়ামী লীগ আমলের নির্বাচনে কেন্দ্র দখলে বাধা দানকারী ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সাহসী বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বশির উদ্দিন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে ও স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামান এবং ৫ আগস্টের আগে-পরে বিপ্লবী ভূমিকা পালনকারী ডিআইজি ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানসহ অনেককেই পদকের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) এবং প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেলের (পিপিএম) জন্য যে ৬২ জনকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ২১ জনই হলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরও পুলিশে গুণগত পরিবর্তন আসেনি। ফ্যাসিবাদ আমলে রাতের ভোট দিনে সম্পন্ন করতে ভূমিকা পালনকারী, ভোটকেন্দ্র দখলে সহায়তাকারী, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ভূমিকা রাখা এবং লবিংয়ে এগিয়ে থাকা কর্মকর্তারাই পদক পেতেন পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে। এবারও একই কায়দায় করা হয়েছে পদকের তালিকা। তালিকায় যারা স্থান পেয়েছেন তাদের আজ সকাল ১০টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস প্যারেড গ্রাউন্ডে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। ২৯ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে ৩ দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ। পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে পদকপ্রাপ্তদের ব্যাজ পরিয়ে দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
পদকের তালিকার ৩৮ নম্বরে আছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুল হক ডাবলু। ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি এক ডিও লেটারে ডাবলু সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু লেখেন, ‘মনিরুল হক ডাবলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের লিয়াকত-বাবু কমিটিতে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির পক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে দুঃসময়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। সে ব্যক্তিগতভাবে মুজিব সৈনিক এবং শেখ হাসিনার একজন নির্ভীক কর্মী।’ ডাবলু ডিএমপির নিউ মার্কেট থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় থানায় ওসির পদায়নের জন্য এই ডিও লেটার ব্যবহার করেছিলেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাকে পদায়ন করা হয় ঢাকার আশুলিয়া থানার ওসি হিসাবে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে তিনি আশুলিয়া থানায় যোগদানের পরই। ডাবলুর দলীয় পরিচয়ের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তাকে ক্লোজড করা হয় পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ে। সম্প্রতি তাকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি করা হয়।
দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে বলেন, এবারের পুলিশ সপ্তাহে পদকের তালিকায় এক নম্বরে থাকা উচিত ছিল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বশির উদ্দিনের নাম। তিনি ট্যুরিস্ট পুলিশে কর্মরত। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের সময় তিনি এএসপি হিসাবে কর্মরত ছিলেন নারায়ণগঞ্জে। তখন নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ভোটকেন্দ্র দখল করতে গিয়েছিল একটি সশস্ত্র দল। ওই দলটি হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘কেউ কেন্দ্র দখলে বাধা দিতে এলে মাথা নিয়ে যেতে পারবে না।’ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাউকে কেন্দ্র দখল করতে দেননি বশির উদ্দিন। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারে অভিযানে যায় বশিরের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল। এ সময় তৎকালীন এমপি শামীম ওসমান হুমকি দিয়ে বশিরকে বলেন, ‘চেয়ারম্যানকে কেন গ্রেফতার করতে এসেছ? কেন্দ্র ছেড়ে দিয়ে দ্রুত চলে যাও।’ তখন শামীম ওসমানকে বশির বলেন, ‘এটা পারব না। আমি প্রজাতন্ত্রের চাকরি করি। কারও অন্যায় আদেশ মানতে আমি বাধ্য না।’ এরপর এএসপি বশিরকে লাইনে রেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পিএস-১ আব্দুল মালেকের সঙ্গে কথা বলেন শামীম ওসমান। বলেন, ‘এএসপি বশির আমাকে রাজনীতি করতে দেবে না। তাকে থামান।’ বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ওই সময় গণমাধ্যমে কথা বলে ভাইরাল হন এএসপি বশির। তখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে কাউকে ভোটকেন্দ্র দখল করতে দিতে পারি না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বশির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, পদক নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। আমি সহকারী কমিশনার এবং অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) থাকা অবস্থায় আইন অমান্যের কারণে অনেক ভিআইপি ব্যক্তির গাড়ি ডাম্পিং করেছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদকের তালিকায় ২ নম্বরে থাকা উচিত ছিল অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামানের নাম। তিনি আওয়ামী সরকারের আমলের অন্যায় আদেশের প্রতিবাদ করতেন সরাসরি। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় তার অবস্থান ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের বিপক্ষে। বিপ্লবের পর তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ঘৃণা এবং পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে সম্মান দেখিয়ে পুলিশের চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। তার ওই পদত্যাগপত্র এখনো গ্রহণ করেনি সরকার।
এ বিষয়ে মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা অপকর্মের মাধ্যমে পুলিশকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। মানুষের ঘৃণার পাত্র হয়ে আমি পুলিশের চাকরি করতে চাইনি। এ কারণে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করায় নভেম্বরে আবারও আবেদন করেছি। এখনো বিষয়টির সুরাহা হয়নি।
সূত্র আরও জানায়, পদকের তালিকায় নাম থাকা উচিত ছিল বিপ্লবী পুলিশ কর্মকর্তা ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানেরও। অন্যায় আদেশ না মানার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুই দফা চাকরি হারিয়েছিলেন তিনি। একবার আদালতের নির্দেশে এবং আরেকবার সরকারের নির্বাহী আদেশে চাকরি ফিরে পেয়েছেন। সরকারের রোষানলে পড়ে দেশ ছাড়তেও বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
এদিকে বিপিএম এবং পিপিএম পদকের জন্য চূড়ান্তভাবে যারা তালিকাভুক্ত হয়েছেন তারা হলেন-সাবেক আইজিপি ময়নুল ইসলাম, র‌্যাব মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) আকরাম হোসেন, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মোসলেহ উদ্দিন আহমদ, অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) ছিবগাত উল্লাহ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার ও অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মাইনুল হাসান, উপমহাপরিদর্শক সরদার নুরুল আমিন, উপ-মহাপরিদর্শক কাজী মো. ফজলুল করিম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ, সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, জিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদুল হাসান, ডিএমপি ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম, সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ রবিউল হোসেন ভূঁইয়া, অতিরিক্ত ডিআইজি আহম্মদ মুঈদ, পিবিআইর অতিরিক্ত ডিআইজি এনায়েত হোসেন মান্নান, খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল, ঢাকার এসপি আনিসুজ্জামান, মাগুরার এসপি মিনা মাহমুদা, চট্টগ্রামের এসপি সাইফুল ইসলাম সানতু, পিবিআইর পুলিশ সুপার কুদরত-ই খুদা, ৮ এপিবিএনের এসপি খন্দকার ফজলে রাব্বি, ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার রওনক আলম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমএম মোহাইমেনুর রশিদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাসেল, নীলফামারীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জুয়েল রানা, ডিএমপির সহকারী পুলিশ সুপার এমজে সোহেল, দোহার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-০১ এর সহকারী পুলিশ সুপার রাশেদুল ইসলাম বিশ্বাস, এপিবিএন উত্তরার পুলিশ পরিদর্শক গাজী গোলাম কিবরিয়া, পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্সপেক্টর আবদুর রাজ্জাক আকন্দ, সিএমপির ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ ফজলুল কাদের চৌধুরী, কেএমপির ইন্সপেক্টর শফিকুল ইসলাম, কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুল হক ডাবলু, আলমডাঙ্গার ওসি মাসুদুর রহমান, সিরাজগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা শাখা পুলিশ পরিদর্শক একরামুল হোসাইন, কাউনিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তফা কামাল, পাবনা জেলা গোয়েন্দা শাখার এসআই শ্রী বেনু রায়, গাজীপুর জেলা পিবিআইয়ের এসআই সুমন মিয়া, গোদাগাড়ী মডেল থানা এসআই বরুন কুমার সরকার, কুমিল্লা জেলা পিবিআইর এসআই ফিরোজ আহাম্মদ, হবিগঞ্জ জেলার এসআই মাহমুদুল হাসান, মির্জাগঞ্জ থানার এসআই এনামুল হক, সিএমপির সোয়াট টিম কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের এসআই রাছিব খান, পুলিশ সদর দপ্তরের এসআই রকিবুল হাসান, ঢাকা জেলা পিবিআইয়ের এসআই ইমরান আহমেদ, সিরাজগঞ্জ জেলা পিবিআইয়ের এসআই মো. আশিকুর রহমান, মুন্সীগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা শাখার এসআই ইয়াসিন, খাগড়াছড়ি থানার এসআই আজিমুল হক, ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চে এএসআই কামরুজ্জামান, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল নিযুক্ত এএসআই নাজমুল হুসাইন, ভাটারা থানা এএসআই মেসবাহ উদ্দিন, র‌্যাব-১৫ এর হাবিলদার সাইফুল ইসলাম, সচিবালয় নিরাপত্তা বিভাগের কনস্টেবল রুহুল আমিন ভূঞা, ঢাকা এটিইউর কনস্টেবল হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের কনস্টেবল মোহাম্মদ জোনাইদুল হক, ডিএমপির পরিবহণ বিভাগের কনস্টেবল মোবারক হোসেন ও ডিএমপির পিওএম-পূর্ব বিভাগের কনস্টেবল রিয়াদ হোসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *