শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
বিএনপিকে বেঁধে ফেলতে অন্তর্বর্তী সরকার তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কারের নামে বিভিন্ন নতুন প্রস্তাব সামনে আনছে বলে মনে করে দলটি। বিএনপির অভিমত, গণতন্ত্রের ইতিহাসে দেশে দেশে যেগুলোর রেগুলার প্র্যাকটিস, সেগুলোও কমিশন উপেক্ষা করতে চাচ্ছে। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশে দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হওয়ার নজির রয়েছে। বাংলাদেশেও দলের প্রধানই সারা জীবন প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসছেন। সুতরাং দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী না হতে পারার প্রস্তাব বিএনপি মানবে না। কমিশন এমন প্রস্তাব করলে তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেবে। দলটি মনে করে, পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে এমন সংস্কারে পার্লামেন্টকে ছোট করা হচ্ছে। সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এতে উত্তরার বিমান দুর্ঘটনা ছাড়াও দলীয়প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারা না পারা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল অন্য দলগুলো অনেক বড় দল নয়। নির্বাচন হলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সেক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাব মেনে নিলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বিএনপির পক্ষে এই সিদ্ধান্ত (দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা) মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ, বিএনপির একটা লিডারশিপ স্ট্রাকচার এবং সারা দেশে নেতৃত্বের একটা ‘চেইন অব কমান্ড’ রয়েছে। এছাড়া নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দলের সংসদীয় কমিটিই ঠিক করে থাকে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন? এখানে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দলের সংসদীয় কমিটি যদি মনে করে, তারা দলীয় প্রধানকেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে, তাহলে গণতান্ত্রিক এ প্রক্রিয়ার সুযোগ বন্ধ করা ঠিক হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি বরাবরই সংস্কারের পক্ষে। সেজন্য তারাই প্রথম ২০২২ সালে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। সুতরাং প্রয়োজনীয় ও যৌক্তিক সংস্কার তারা চান। তবে বর্তমানে অযৌক্তিক অনেক সংস্কার প্রস্তাব আনা হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য বিএনপিকে বেঁধে ফেলা। কারণ, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আগামীতে বিএনপিই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাবে। সম্প্রতি বিভিন্ন সংগঠনের জরিপেও সে তথ্য উঠে এসেছে। সুতরাং কোনো অযৌক্তিক সংস্কার প্রস্তাব বিএনপি মানবে না। তাদের যুক্তি, বিশ্বের গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসাবে পরিচিত যুক্তরাজ্যে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হয়ে থাকেন। এ ছাড়া পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান হিসাবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। আমাদের দেশেও দলীয় প্রধানরাই সারা জীবন প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসছেন। তাছাড়া বাংলাদেশে দলীয় প্রধানের পরিচয়েই মূলত সেই দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষেত্রেও দলীয় প্রধানের পরিচয়ই মুখ্য ভূমিকা রাখে।
স্থায়ী কমিটির নেতারা আরও বলেন, আমরা বলেছি নির্বাচনে বিজয়ী হলে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করব। এর অংশ হিসাবে মিত্রদের মধ্যে আগামী নির্বাচনে আমরা যাদের ধানের শীষের মনোনয়ন দেব, তারা তো বিএনপি প্রধানের নেতৃত্ব মেনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। সুতরাং দলীয় প্রধানের প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার এমন ‘অযৌক্তিক’ প্রস্তাব মানার প্রশ্নই ওঠে না।
স্থায়ী কমিটির গত বৈঠকের মতো এ বৈঠকেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। দলটি তাদের মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি আছে। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না। স্থায়ী কমিটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা অর্থাৎ স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দু-একটি বিষয়ে ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রপতিকে যদি ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা হয়, তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র তেমন অর্থবহ থাকবে না। সেক্ষেত্রে সংসদেরই বা কী দরকার। প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। তবে এ আলোচনায় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা নিয়ে আগামীতে আরও আলোচনা হবে। এছাড়া স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সোমবার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের মর্মান্তিক ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে সভায় শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় নিহত ছাত্রছাত্রী ও পাইলটের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের আশু সুস্থতা কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন-স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।