তারেক হোসাইন:
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত জেলে সম্প্রদায় আজ মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় মাছ ধরা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনার হাজার হাজার জেলে পরিবার এখন দারিদ্র্য, খাদ্য সংকট এবং কর্মহীনতার দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে।
স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, আগের মতো আর মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড় ও সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কারণে সপ্তাহের পর সপ্তাহ নৌকা চালানো যায় না। নিরাপত্তার ঝুঁকি এড়াতে তারা সাগরে নামতে পারছেন না। দীর্ঘ সময় মাছ না ধরতে পারায় পরিবার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
ভোলার চরফ্যাশনের এক জেলে আবদুল করিম বলেন, “আগে প্রতিদিন সাগরে গেলে হাতে খালি ফিরতে হতো না। এখন তিন-চার দিনেও মাছ মেলে না। আবার ঘূর্ণিঝড় উঠলে ১০–১২ দিন পর্যন্ত সাগরে নামা যায় না। ঘরে ফিরে বউ-বাচ্চাদের চোখে চোখ রাখতে কষ্ট হয়।”
কর্মহীন অবস্থায় অনেক জেলে পরিবার ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। স্থানীয় মহাজন ও এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে না পারায় ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। সংসার চালাতে গিয়ে অনেক জেলে পরিবার সর্বস্ব হারানোর পথে।
জেলেদের নারীরা বলছেন, প্রতিদিন বাজার থেকে খাবার কিনতে টাকা জোগাড় করা কঠিন হয়ে গেছে। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। অনেক শিশু স্কুল ছেড়ে শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি মাছের প্রজনন চক্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদী-সাগরে লবণাক্ততার বৃদ্ধি। ফলে আগের মতো মাছ আর ধরা যাচ্ছে না। অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে বা গভীর সমুদ্রে সরে যাচ্ছে।
ঢাকার এক পরিবেশবিদ জানান, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরে মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইলিশ ও অন্যান্য উপকূলীয় মাছের সংখ্যা দ্রুত কমছে। জেলেরা আগের তুলনায় অর্ধেকও মাছ পাচ্ছেন না।”
সরকার ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ক্ষুদ্র নৌকা বিতরণ, মাছের বীজ সরবরাহ, বিকল্প জীবিকা প্রশিক্ষণ এবং পুনর্বাসন কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। তবে জেলেরা বলছেন, এসব সাহায্য যথেষ্ট নয়।
বরগুনার এক জেলে নেতা বলেন, “সরকার কিছু জেলে পরিবারকে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সংখ্যা খুবই কম। হাজারো জেলে এখনো ত্রাণ বা বিকল্প জীবিকার সুযোগ পায়নি।”
মানবিক সংকট
জেলেদের সন্তানরা নিয়মিত স্কুলে যেতে পারছে না। খাদ্য ও পোশাকের সংকটে তাদের পড়াশোনার প্রতি অনীহা তৈরি হচ্ছে। নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষ করে অপুষ্টি, ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগ বেড়েছে। পরিবারগুলো চরম মানসিক চাপের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
এক জেলে স্ত্রী বলেন, “স্বামী সাগরে গেলেও মাছ পায় না। ঘরে খাওয়ার মতো খাবার নেই। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দিতে পারি না। ঋণের কিস্তি দিতে না পারলে মহাজন গালমন্দ করে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ সংকট কেবল স্থানীয় নয়, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গেও যুক্ত। কারণ বাংলাদেশের মাছের বড় অংশ উপকূলীয় অঞ্চল থেকেই আসে। যদি জেলে সম্প্রদায় টিকে থাকতে না পারে, তবে দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য সরবরাহও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তারা সতর্ক করেছেন, “যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আগামী দশকেই উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়ের জীবন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে। এতে সামাজিক অস্থিরতা ও ব্যাপক অভিবাসনের ঝুঁকি তৈরি হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল অস্থায়ী ত্রাণ দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উপকূলীয় বাঁধ মজবুতকরণ, সাগরে নিরাপদ মাছ ধরার ব্যবস্থা, বিকল্প জীবিকা উন্নয়ন, জেলেদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি।
এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, উপকূলের বনায়ন, নদী ও জলাশয় সংরক্ষণ, এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈশ্বিক অর্থায়ন জেলে সম্প্রদায়ের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায় বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মজীবী শ্রেণি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে তারা এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। মাছ ধরার সুযোগ কমছে, আয় হ্রাস পাচ্ছে, পরিবার ভাঙনের পথে। সাময়িক ত্রাণ বা সাহায্য দিয়ে এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। জেলেদের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সমন্বয় প্রয়োজন। নইলে বাংলাদেশ তার উপকূলীয় সংস্কৃতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির এক বড় স্তম্ভ হারাতে বসবে।