জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব: ড. ইউনূসের

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা যায়। রোহিঙ্গা সমস্যাকে মিয়ানমারের বৃহত্তর সংস্কারের ওপর ফেলে রাখা উচিত হবে না।
গতকাল মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও অন্য সংখ্যালঘুদের নিয়ে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের সভাপতি জার্মান কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ আনালিনা বায়েরবক দিনব্যাপী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।
জাতিসংঘ আয়োজিত সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন ও সমাপনী অধিবেশনের পাশাপাশি মধ্যাহ্নভোজের বিরতির আগে ও পরে দুটি প্লেনারি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় চার ঘণ্টার দুই প্লেনারিতে জাতিসংঘের সদস্যদেশ, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিসহ ৬৩ জন বক্তব্য দেন। সারা দিনের আলোচনা শেষে উচ্চপর্যায়ের রোহিঙ্গা সম্মেলনের বিষয়ে চেয়ার সামারি (সারসংক্ষেপ) প্রকাশ করার কথা রয়েছে।প্রায় দুই ঘণ্টার উদ্বোধনী আলোচনায় বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্য তাঁর শেফ দ্য ক্যাবিনেট কোর্টনি রেটারি পড়ে শোনান। বক্তব্য দেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং রোহিঙ্গাদের চারজন প্রতিনিধি।
বক্তব্যে মিয়ানমারে দশকের পর দশক ধরে সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন-সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, ২০২১ সালে দেশটিতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর সংকট আরও গভীর হয়েছে।গত ১৮ মাসে বাংলাদেশে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গার পালিয়ে আসার তথ্য উল্লেখ করে গুতেরেস বলেন, বাংলাদেশ উদারতা দেখিয়ে সীমান্ত খোলা রেখেছে এবং তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
সংকট সমাধানে অবিলম্বে তিনটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। সেগুলো হলো প্রথমত, সব পক্ষকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা আইন ও মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের ভেতরে বাধাহীনভাবে মানবিক সহায়তা যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কোনো সম্প্রদায়কে খাবার, ওষুধ ও জীবনরক্ষাকারী সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তৃতীয়ত, জোরালো মানবিক সহায়তা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বিনিয়োগ দরকার। এটা প্রয়োজন মৌলিক চাহিদা পূরণ, শরণার্থীদের পরনির্ভরশীলতা থেকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে এবং আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ কমানোর জন্য।আট বছর আগে মিয়ানমারে গণহত্যা শুরু হলেও রোহিঙ্গাদের দুর্দশা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বক্তব্যে তিনি বলেন, সংকট সমাধানে যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, আর আন্তর্জাতিক সহায়তাও মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির কথা বলেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের উৎস মিয়ানমার আর এর সমাধানও সেখানে নিহিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করে এবং দ্রুত তাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে। এটিই সংকটের একমাত্র টেকসই সমাধান। মিয়ানমারের বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কারের কাছে জিম্মি করে এ প্রক্রিয়াকে ফেলে রাখা চলবে না।

রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কমছে। তাই একমাত্র শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পথ হলো প্রত্যাবাসন শুরু করা। দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক সুরক্ষার তুলনায় প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়ায় অনেক কম সম্পদের প্রয়োজন হবে। রোহিঙ্গারা নিজেরাই বারবার দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। জরুরি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যারা সাম্প্রতিক সংঘাত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা উচিত।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে সাত দফার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, একটি টেকসই সমাধানের জন্য আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো প্রস্তাব করছি:প্রথমত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত পথনকশা তৈরি করা এবং রাখাইনের পরিস্থিতি যৌক্তিকভাবে স্থিতিশীল করা। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধ করা এবং টেকসই প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্যে মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করা। প্রথমে বাংলাদেশে সদ্য আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে তাদের ফেরানো শুরু করা। তৃতীয়ত, রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ করা এবং তা পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। চতুর্থত, রাখাইনের সমাজ ও শাসনব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের টেকসই অন্তর্ভুক্তির জন্য আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ। পঞ্চমত, যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায় (জেআরপি) দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থের পুরোটা নিশ্চিত করা। ষষ্ঠত, জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও পুনর্বাসনমূলক ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা। সপ্তমত, মাদক–অর্থনীতি ধ্বংস করা এবং আন্তসীমান্ত অপরাধ দমন করা।
দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের আর অপেক্ষায় রাখতে পারে না উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আসুন, আজ আমরা অঙ্গীকার করি, একসঙ্গে কাজ করে চিরতরে এই সংকটের সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ এ লক্ষ্যে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিতে তৈরি আছে।’- বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *