ওবায়দুল কাদেরকে খুশি করতে ভাসানচরকে হাতে তুলে দেন সাবেক এমপি মিতা

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

ফের মানচিত্রে যুক্ত হচ্ছে সন্দ্বীপ। নতুন করে চর জাগলেও কাগজপত্রে বিলীন হয়ে যাওয়া সন্দ্বীপের সঙ্গে তা যোগ হয়নি। পতিত হাসিনা সরকারের আমলে খোদ দ্বীপের একটি সিন্ডিকেট নতুন চরগুলোর বেশিরভাগ অংশ নোয়াখালীর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সন্দ্বীপ-নোয়াখালীর এই সীমানা বিরোধ ফের সামনে আসে। জানা গেছে ওবায়দুল কাদেরকে খুশি করতে ভাসানচরকে হাতে তুলে দেন সাবেক এমপি মিতা। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে দ্রুত সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালে দ্বীপটির মালিকানায় থাকা ৬ মৌজাসহ উরিরচরের দুটি ইউনিয়নকে নোয়াখালী জেলার অধীনে দিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ, পতিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে তৎকালীন প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দলের সাধারণ সম্পাদককে খুশি ও নিজের নমিনেশন পোক্ত করার জন্য খোদ সন্দ্বীপের পতিত এমপি মাহফুজুর রহমান মিতাও সে সময় এর বিরোধিতা করেননি বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানান। উলটো নোয়াখালীর পক্ষে ডিও লেটার দেন। তৎকালীন সরকারের ওই সিদ্ধান্তে গোটা সন্দ্বীপের সাধারণ মানুষ সে সময় ফুঁসে উঠেছিলেন। মামলা হয় উচ্চ আদালতে। সন্দ্বীপের বাসিন্দা মনিরুল হুদা হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের একরোখা সিদ্ধান্তের কারণে বাতিল করা সম্ভব হয়নি সন্দ্বীপবিরোধী ওই একতরফা আদেশ। সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা আত্মগোপনে থাকায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বঙ্গোপোসাগরের বুক চিরে তৈরি হচ্ছে বিশালায়তনের নতুন এক সন্দ্বীপের। নতুন সন্দ্বীপের বর্তমান মোট আয়তন ৭২১ বর্গকিলোমিটার বেশি হতে পারে। তাদের মতে, সাগরে পলিমাটি জমে প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে দ্বীপটি। ইতোমধ্যে জাহাইজ্যারচর, ভাসানচর, উরিরচর নানাভাবে সন্দ্বীপের সঙ্গে মিশে গেছে। পলি জমে চরগুলোর আয়তনও বাড়ছে। তাদের মতে অদূর ভবিষ্যতে এসব চর সন্দ্বীপের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হবে বিশাল এক দ্বীপাঞ্চল। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) এক গবেষণাতেও এসব তথ্য উঠে এসেছে।
স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহমুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা স্যাটেলাইট ছবি থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে থাকি। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। জাহাইজ্যারচর ২০ বছরে অনেক বড় হয়ে গেছে। এটি আগে অনেক ছোট ছিল। ২০০০ সালের ছবিতে ভাসানচর দেখাই যেত না। ধীরে ধীরে জাহাইজ্যারচর, ভাসানচর সন্দ্বীপের সঙ্গে মিশে একটা বড় দ্বীপের অংশ হয়ে যাচ্ছে। আমরা জোয়ারের সময়ের ছবিও নিয়েছি। এ গবেষণায় বলা হয়েছে এসব চর মিলে সন্দ্বীপের মোট আয়তন প্রায় ৭২১ বর্গকিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শহীদুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিবছর দুই থেকে তিন বিলিয়ন টন পলি আসে। গড়ে যার ৩ ভাগের ১ ভাগ আমাদের নদী-নালা, খালবিলে পড়ে। আরেক ভাগ সমুদ্রে পুরোপুরি হারিয়ে যায়। আর বাকি এক ভাগ সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় জমা হয়। এই জমার পরিমাণ এখন অনেক বেশি। স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই মুহূর্তে সুখবর হচ্ছে, দ্বীপটি আর ভাঙছে না। তাদের মতে বিরোধপূর্ণ ভাসানচরটি ছিল মূলত নদীতে ভেঙে যাওয়া সন্দ্বীপের ন্যায়মস্তি ইউনিয়নের অংশ। দূরে জেগে ওঠা উরিরচরকে সন্দ্বীপের হিস্যায় দেওয়া হলেও কাছের ভাসানচর বা ঠ্যাংগারচরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল নোয়াখালী তথা হাতিয়া উপজেলার প্রযত্নে।
সন্দ্বীপের মানুষ মনে করেন, এটা সরকারের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল। সন্দ্বীপের মানুষ বারবার সভা-মানববন্ধন, মিছিল করে ভাসানচরকে সন্দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে ন্যায়মস্তি ইউনিয়নের নদী শিকস্তি পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সাবেক ফ্যাসিস্ট এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার অসহযোগিতায় সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সন্দ্বীপ-নোয়াখালীর এই সীমানা বিরোধ ফের সামনে আসে। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে দ্রুত সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়। হাইকোর্ট এ বিষয়ে রুলনিশি জারি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২ ফেব্রুয়ারি ভূমি সচিবের নেতৃত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বৈঠক হয়। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত কমিশনারের (রাজস্ব) সভাপতিত্বে ওই বৈঠক হয়। সভায় সীমানাসংক্রান্ত এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দুই জেলার জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের সহযোগিতায় সিএস ও আরএস রেকর্ডের তুলনামূলক নকশার পেন্টাগ্রাফ করে সীমানা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার চট্টগ্রাম তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী বিরোধপূর্ণ ভাসানচর বা ঠেঙ্গার চরের ৬টি মৌজা সন্দ্বীপের অংশ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয়ের চার্জ অফিসার ও জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের নেতৃত্বে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধপূর্ণ ঠেঙ্গার চরের ৬টি মৌজা যেমন ভাসানচর, শালিকচর, চর বাতায়ন, চর মোহনা, চর কাজলা ও কাউয়ারচরের সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) ও আরএস-এ পেন্টাগ্রাফ এবং আর্কাইভ জিআইএস পদ্ধতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ভাসানচরের ৬টি মৌজা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সীমানায় অন্তর্ভুক্ত মর্মে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু দিয়ারা জরিপে এই ৬টি মৌজাকে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সব দিক বিবেচনা করে বিরোধপূর্ণ এ চরটি (ভাসানচর) সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত মর্মে প্রতীয়মান হয়।
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিগ্যান চাকমা যুগান্তরকে বলেন, ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুই জেলার সেটেলমেন্ট অফিসারের দেওয়া রিপোর্ট নিয়ে বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে বিরোধ মীমাংসা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তিনি বলেন, যে ভাসানচর নিয়ে এই বিরোধ সেটি সন্দ্বীপ থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। অপরদিকে হাতিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ১৯৫৪ সালে এটি নোয়াখালী থেকে আলাদা হয়ে যায়, পরে ১৯৫৫ সালে সন্দ্বীপের গেজেটভুক্ত হয়। গেজেটে সন্দ্বীপের ৬০টি মৌজার কথা উল্লেখ থাকলেও নদী ভাঙনের ফলে বর্তমানে ৩৮টি মৌজার অস্তিত্ব রয়েছে। উরিরচরের কিছু মৌজাও সাগরের ভাঙনে একেবারে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। ২০০৩ সালের পর থেকে এসব জায়গায় আর নির্বাচন করা যাচ্ছে না। তার মতে ২০১৪ সালেও সন্দ্বীপের ১০৫০ হেক্টর জমিতে বনায়ন করা হয়েছে যার অনুকূলে গেজেট আছে। কাজেই এটা স্পষ্ট ভাসানচর সন্দ্বীপের অংশ।
নোয়াখালী জেলার চার্জ অফিসার মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দীন বলেন, সিএস ও আরএস বিশ্লেষণ করে ভাসানচর হাতিয়া অংশে পাওয়া যায়নি। সন্দ্বীপের সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার এসবি বিমলেন্দু দাশ যুগান্তরকে বলেন, ভাসানচরের ৬টি মৌজাকে গুগল ম্যাপের কো-অর্ডিনেট করলে এটি সন্দ্বীপের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়। গুগল ম্যাপের দূরত্ব পরিমাপে ভাসানচর সন্দ্বীপের ন্যামস্তি মৌজা ম্যাপ থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত আর হাতিয়া থেকে ২১ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। কাজেই এটি সন্দ্বীপের অংশ।
সন্দ্বীপ ডেভেলপমেন্ট ফোরামের সভাপতি নুরুল আক্তার যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রামের সঙ্গে ফেরি সার্ভিস চালু করা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ। ফেরি সার্ভিস চালু হওয়ায় সন্দ্বীপ ঘিরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে নানা চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা শুরু করেছেন। এখানে এখন বড় বড় শিল্পকলকারখানা গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, সন্দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করে গোটা বিশ্বের সঙ্গে সন্দ্বীপকে সংযুক্ত করা সম্ভব।
এলজিইডি সন্দ্বীপ উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল আলীম যুগান্তরকে বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সন্দ্বীপের মূল সড়ক রহমতপুর গুপ্তছড়া সড়কটি সংস্কার করা হবে। এরপর মুছাপুর আলীমিয়ার বাজারসংলগ্ন সড়ক ও এনাম নাহার থেকে শিবের হাট সড়কটি সংস্কার করা হবে। পর্যায়ক্রমে সন্দ্বীপের অন্যান্য মূল সড়কগুলোর কাজে হাত দেওয়া হবে। ফেরি সার্ভিস চালু হওয়ায় সন্দ্বীপে প্রচুর যানবাহন প্রবেশ করছে। এজন্য দ্রুত রাস্তা সংস্কার করা দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *