জলাই অভ্যুত্থানের আগে-পরে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য, জনমনে প্রশ্ন

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

সেনা সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ। এরপর ভারতের সমর্থনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে একনায়কতন্ত্র তথা ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করেও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে পারছিল না।
এমনই প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষের মুক্তির দূত হয়ে আবির্ভূত হয় ছাত্র-জনতার একক শক্তি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক এক গণঅভ্যুত্থান তথা বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে। যার মূল নেতৃত্বে ছিল দেশের ছাত্র সমাজ।
অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বেই স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে অংশ নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যান্য দলের মতো গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার ছাত্রদের কৃতিত্বকে স্বীকার করেছেন বিএনপির নেতারা। কিন্তু পরবর্তীতে সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্র সংস্কার, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, জুলাই প্রক্লেমেশন এবং বিশেষ করে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন করাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দাবি, সংবিধান, রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামো, গণমাধ্যম ও অন্যান্য ফ্যাক্টর দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। তাই ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্যই জুলাই-আগস্টে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। যার ফলশ্রুতিতে দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্বসহ ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে আহত হতে হয়েছে। তাই বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নন তারা।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সেই লক্ষ্যেই কাছ করছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বরাবরই বলে আসছেন, মোটাদাগে কিছু সংস্কার শেষ করে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই একটা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়া হবে।
দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এই সংস্কারের বিষয় নিয়ে সরাসরি দ্বিমত পোষণ করেনি। কিন্তু দলটির সিনিয়র কিছু নেতার বক্তব্যে ইদানিং নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে খোদ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, স্থায়ী কমিটির সালাহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং মির্জা আব্বাসের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হচ্ছে।
বিপ্লব সফল হওয়ার পর এসব নেতা কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই এর ক্রেডিট দিয়েছেন ছাত্রদের। রিজভী তো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ছাত্ররা এই জাতিকে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছে। আর দেওয়াটাও তো স্বাভাবিক। কারণ বছরের পর বছর আন্দোলন করেও দলটি হাসিনা সরকারকে কাবু করতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ‘ভুল ও সিদ্ধান্তহীনতা’র কারণে ফ্যাসিবাদী শাসন পাকাপোক্ত হয়েছে।
ছাত্রদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সফলের পরই দলটির নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গৃহবন্দি থেকে মুক্ত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে করা হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সারা দেশে মুক্তি পেয়েছেন লাখ লাখ নেতাকর্মী। এমনকি যে সালাহ উদ্দিন আহমেদ এখন শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে কথা বলছেন, তিনিও কয়েক বছর পর জুলাই অভ্যুত্থানের পরই দেশে ফিরতে পেরেছেন।
গণঅভ্যুত্থান সফলের পর গত বছরের ১১ আগস্ট সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে এদেশে একটা নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার বিপ্লব হয়েছে। অথচ রোবাবর (১৩ এপ্রিল) তিনি বলেছেন, কেউ যদি এটাকে বিপ্লব বলতে চায়, তাহলে আমি দুঃখ প্রকাশ করব। এটা কোনো সামাজিক বিপ্লব নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, আপনারা যে অনির্বাচিত সেটা আমরা বার বার স্মরণ করিয়ে দেব।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের এখন একমাত্র দাবি হলো- নির্বাচন এবং সেটা আসছে ডিসেম্বরের মধ্যেই দিতে হবে। তা নাহলে তারা রাস্তায় নামারও ঘোষণা দিয়েছেন।
খোদ দলটির মহাসচিব গত ২৯ মার্চ বলেছেন, দল ও দেশের জনগণের স্বার্থে আঘাত এলে আবারও মাঠে নামবে বিএনপি। তিনি একাধিকবার অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ছাত্রদের রাজনৈতিক দল নিয়ে কটাক্ষ করে বলেছেন, যারা ১০০ গাড়ি নিয়ে ইলেকশন ক্যাম্পেইন করতে যায়, তারা কী করবে, সেটা আমরা ভালো বুঝি।
সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, নারীদের হেনস্থা করে সারা দেশে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান সম্পর্কে কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, অপারেশন ডেভিল হান্ট কী ভাই! ডেভিল হান্ট সম্পর্কে জানি না। একমাত্র ডেভিল তো আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারকেই জানি। অথচ এই মির্জা ফখরুল গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে বলেছিলেন, দানবের হাত থেকে জাতি মুক্তি পেল।
বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা রিজভীও সরকারের কম সমালোচনা করছেন না। গত ৩০ মার্চ তিনি সরকারকে লক্ষ্য করে বলেছেন, সংস্কারের কথা বলে আপনারা জনগণের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন।
গত বছরের নভেম্বর ১২ বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি সরানোর সমালোচনা করেন তিনি। আর গত ২১ মার্চ বলেছেন, জনগণ আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলে আমাদের কিছু বলার নেই। সর্বশেষ আজ সোমবার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি বলেছেন, সরকারের অনেক উপদেষ্টা বিএনপির সঙ্গে শত্রুতা করছেন। আগের দিন ১৩ এপ্রিল রিজভী বলেছিলেন, সংস্কার চিরস্থায়ী কোনো বন্দোবস্ত নয় যে বছরের পর বছর করে যাবেন।
অথচ এই রিজভী কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন ফ্যাসিবাদ পতনের দুই দিন পর। গত বছরের ৭ আগস্ট কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা জীবন দিয়ে জাতিকে মুক্ত করেছে।’
অপরদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এবং ঢাকার বর্ষিয়ান রাজনীতিক মির্জা আব্বাস সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেক বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে নানা মহলে নানা সমালোচনাও হয়েছে।
গত ৪ এপ্রিল একটি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একটা সরকার কত দিন বিনা নির্বাচনে থাকতে পারে? তার সবচেয়ে সমালোচনার জন্ম দেওয়া বক্তব্য হলো- ওদের (অন্তর্বর্তী সরকার) হাতের কোনো সংস্কার আমরা সহজে মেনে নেব না। গত ১৬ মার্চ এই বক্তব্য দিয়েছেন মির্জা আব্বাস।
এছাড়া গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর তিনি বলেছিলেন, সংবিধানকে কবর দেওয়ার কথা বললে কষ্ট লাগে। অথচ ফ্যাসিবাদের আমলে বিএনপি নেতারা অনেকবার বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে এই সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে।
যাই হোক, মির্জা আব্বাস চলতি বছরের ২৬ মার্চ বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, এখন আমরা নতুন করে পেয়েছি ৫ আগস্টের পরে।’
আর ফ্যাসিবাদ পতনের দুই দিন পর গত ৭ আগস্ট বিএনপির এই নেতা বলেছিলেন, বিদেশি কোনো প্রভুর সহায়তা ছাড়াই আন্দোলন সফল হয়েছে।
যদিও ফ্যাসিবাদ পতনের মাত্র কয়েকদিন আগে ২৯ জুন মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ২৮ অক্টোবর ফলাফল চূড়ান্ত হতো, মৃত্যুভয়ে দাঁড়াতে পারিনি।
মনে করা হচ্ছে, দেশের আগামী নির্বাচনে বড় দল হিসেবে বিএনপিরই ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তারপরও ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলটির বিরোধিতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র নির্বাচনকে টার্গেট করে দলটির নেতাদের এমন বক্তব্য ভালভাবে নিচ্ছে না মানুষ। বরং ছাত্র-জনতা তথা সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আবারও দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
কারণ ভুক্তভোগী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, ফ্যাসিবাদের দোসর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন এবং বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পক্ষে যেখানে বিএনপির অবস্থান নেওয়ার কথা ছিল, সেখানে এসবের বিরোধিতা করার কারণেই জনমনে এমন পারসেপশন তৈরি হয়েছে। তাদের এই অবস্থান স্পষ্টতই ছাত্র-জনতা তথা দেশের জনগণের দীর্ঘ প্রত্যাশার বিরুদ্ধে।  -যুগান্তর

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *