শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
দেশের শিল্পকারখানায় চরম গ্যাস-সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাস না থাকায় অনেক স্থানে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও উৎপাদন নেমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। শুধু শিল্প নয়, বাসাবাড়ি ও সিএনজি স্টেশনেও চলছে গ্যাসের জন্য হাহাকার। গ্রীষ্মে লোডশেডিং কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোয় এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশীয় গ্যাসের উত্তোলন কমতে থাকায় সামনের দিনে সংকট আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। ৩০০ থেকে ৩২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু এই চাহিদার বিপরীতে ২৮ এপ্রিল গ্যাস সরবরাহ করা হয় ২৭০ কোটি ঘনফুট। সেখান থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেওয়া হয় প্রায় ১১০ কোটি ঘনফুট। বাকি ১৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিয়ে শিল্পকারখানা, বাসাবাড়ি ও সিএনজি স্টেশনের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে শিল্প-কারখানাগুলোকে।
ঢাকার সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসংদীর শিল্পকারখানায় গ্যাস-সংকট চরমে উঠেছে। এতে অর্ডার ধরে রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন সেখানকার রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস কারখানার মালিকেরা। গার্মেন্টস কারখানা ছাড়াও সিরামিক, ইস্পাত, রি-রোলিং মিল ও টেক্সটাইল খাতের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন। ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে সংস্থাটি। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের চাহিদা রয়েছে ১৯০ কোটি ঘনফুট, আমরা পাচ্ছি ১৫০ কোটি ঘনফুট। যা পাচ্ছি তা থেকে একটি বড় অংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে। সে কারণে চাহিদা অনুযায়ী কলকারখানায় গ্যাস সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না।’
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিদেশ থেকে আমদানি করে এই সংকট সমাধান করা যাবে না। সংকট সমাধানে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে জোর দেওয়া দরকার।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি বড় বিপদে পড়বে।
লোডশেডিং থেকে মুক্তি নেই
শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও পুরোপুরি লোডশেডিং মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকৌশলীরা বলছেন, গত মাসের (এপ্রিল) শেষ সময়ে এসে দেশে বিদ্যুতের গড় চাহিদা দাঁড়ায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় , তাতে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ঘাটতি ছিল। ফলে রাজধানীকে লোডশেডিং মুক্ত রাখা গেলেও সারা দেশের গ্রাম পর্যায়ে লোডশেডিং ভোগান্তি ঠিকই রয়ে গেছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি যেন না হয়, সেজন্য দৈনিক ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা গ্যাসের পরিমাণ এর নিচে নেমে গেলে রাজধানীতেও তীব্র লোডশেডিং দেখা দেবে। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ একই হারে রাখলে কলকারখানা অচল হয়ে পড়বে।
এলএনজি নির্ভরতার শুরু যেভাবে
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ছিল দৈনিক ১৭৪ কোটি ঘনফুট। এরপর দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের জন্য নতুন কূপ খনন ও বিদ্যমান কূপের সংস্কার কাজ হাতে নেওয়া হয়। এতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বেড়ে দৈনিক ২৭০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছায়। স্থলভাগে বড় ধরনের গ্যাসের মজুত পাওয়া যাবে না, এমন বিবেচনায় সরকার সাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি স্থাপন করে এর একটি দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জিকে, অপরটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান সামিটকে। দুটো টার্মিনাল দেওয়া হয় বিশেষ আইনে বিনা দরপত্রে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতা নিয়ে এক্সিলারেট এনার্জির এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় আর সামিটের এলএনজি টার্মিনাল উৎপাদনে আসে ২০১৯ সালের এপ্রিলে।
পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের এপ্রিল জুড়ে গড়ে দৈনিক ৩১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি ছিল ১০০ কোটি ঘনফুট, বাকি ২১০ কোটি ঘনফুট ছিল দেশীয় গ্যাস। ২৮ এপ্রিল গ্যাস সরবরাহ করা হয় ২৭০ কোটি ঘনফুট, যা আগের বছরের তুলনায় ৪০ লাখ ঘনফুট কম; যার সবটুকুই দেশীয় গ্যাস, যার এখন দৈনিক উৎপাদন এসে দাঁড়িয়েছে ১৭০ কোটি ঘনফুটে।
দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে সর্বোচ্চ দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আরও দুটি এলএনজি টার্মিনালের অনুমতি দিয়েছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সে দুটি এলএনজি টার্মিনাল বাতিল করেছে। বিপরীতে সরকার একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তবে বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, দরপত্র আহ্বান করে নতুন টার্মিনাল স্থাপনে বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। ফলে সহজেই যাচ্ছে না গ্যাস-সংকট।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের স্থলভাগে বড় ধরনের গ্যাসের মজুত মিলবে না, কমে যাবে বিদ্যমান কূপের উৎপাদন। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের বিবিয়ানা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পটুয়াখালীর পায়রায় একটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেটের সঙ্গে চুক্তি সই করে পেট্রোবাংলা। আর ২০২৪ সালের মার্চে কক্সবাজারের মহেশখালীতে সামিটের সঙ্গে ভাসমান আরেকটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি সই করা হয়। এ দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা যেত। এই দুটি চুক্তিই গত বছরে অক্টোবরে বাতিল করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। সেই সঙ্গে ডিপ ড্রিলিং থেকেও সরে আসে পেট্রোবাংলা।