ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জার্মানির নজিরবিহীন সমালোচনা, ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

গাজায় চলমান বর্বরতা নিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বার্লিন সাফ জানিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহৃত হয় এমন কোনো অস্ত্র তারা ইসরায়েলকে সরবরাহ করবে না। প্রয়োজনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দিয়েছে জার্মানি। তবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা জানা যায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হলোকাস্ট ও অ্যান্টি সেমিটিজম নিয়ে কঠোর আইন করেছে জার্মানি। সেখানে ইসরায়েল বিরোধী যে কোনো তৎপরতাকে ইহুদি বিদ্বেষী বলে সাব্যস্ত করা হয়। গাজা পরিস্থিতি নিয়ে চ্যান্সেলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন সমালোচনা নজিরবিহীন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পর জার্মানিই দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে আসছিল। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েল ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়তে থাকলেও জার্মানি দেশটিকে সমর্থন জুগিয়ে আসছিল। এই সমর্থন শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইসরায়েল বিষয়ে তাদের নীতি পুনর্বিবেচনা করছে এবং যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা গাজা ইস্যুতে ‘কঠোর পদক্ষেপের’ হুমকি দিয়েছে।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োহান ওয়াডেফুল সম্প্রচারমাধ্যম ডব্লিউডিআরকে বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির ঐতিহাসিক সমর্থনকে অন্যায় কাজে ব্যবহার করা উচিত নয়। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাপক বিমান হামলা এবং খাদ্য ও ওষুধের তীব্র ঘাটতি গাজার পরিস্থিতিকে ‘অসহনীয়’ করে তুলেছে।
এর আগে, ফিনল্যান্ডে এক সংবাদ সম্মেলনে চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ ম্যার্ৎজ গাজায় বিমান হামলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একে ‘আর বোধগম্য নয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
জার্মানির এই সুর পরিবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, নাৎসি হলোকাস্টের পটভূমিতে ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির একটি বিশেষ দায়বদ্ধতার নীতি (রাষ্ট্রীয় কারণ) রয়েছে। এই পরিবর্তন দেশটির জনমত পরিবর্তনেরও প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াডেফুল জোর দিয়ে বলেন, ‘ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ লড়াই এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থনকে গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাত ও যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়।’
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ সম্পর্কে ওয়াডেফুল বিস্তারিত না জানালেও তিনি বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে আছি যেখানে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিয়ে খুব সাবধানে ভাবতে হবে।’ তিনি হুঁশিয়ারি দেন, ‘যেখানে আমরা ক্ষতির আশঙ্কা দেখব, আমরা অবশ্যই হস্তক্ষেপ করব এবং নিশ্চিতভাবে এমন অস্ত্র সরবরাহ করব না যাতে আরও ক্ষতি হয়।’
বর্তমানে ইসরায়েলের কাছ থেকে কোনো নতুন অস্ত্রের আবেদন বিবেচনাধীন নেই বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, জার্মানির বর্তমান সরকারের জোটসঙ্গী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষ থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধের আহ্বানের পরই সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। দলটি মনে করে, অন্যথায় যুদ্ধাপরাধে জার্মানির জড়িত থাকার ঝুঁকি রয়েছে।
জাতিসংঘ সমর্থিত একটি পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক গাজা হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ২০ লাখের বেশি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছেন। মার্চে ভেঙে যাওয়া স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধবিরতি পুনরায় চালুর প্রচেষ্টায় তেমন অগ্রগতি না হলেও, দোহায় আলোচনা এখনো চলছে বলে জানা গেছে।
গাজায় বর্বরতা: আন্তর্জাতিক মিত্র হারাচ্ছে ইসরায়েলগাজায় বর্বরতা: আন্তর্জাতিক মিত্র হারাচ্ছে ইসরায়েল
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ম্যার্ৎজ গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সত্ত্বেও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে জার্মানিতে স্বাগত জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি তিনি ফিনল্যান্ডে বলেছেন, ‘গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলিদের ব্যাপক সামরিক হামলা আমার কাছে আর কোনো যুক্তি তুলে ধরে না যে, কীভাবে তা সন্ত্রাস মোকাবিলার লক্ষ্য পূরণ করছে!’
ইসরায়েলে জার্মান অস্ত্র রপ্তানির বিষয়ে চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মার্ৎজ কোনো মন্তব্য না করলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াডেফুল জানিয়েছেন এটি জার্মান নিরাপত্তা পরিষদের গোপনীয় বিষয়। জার্মানির পরবর্তী পদক্ষেপে অস্ত্র চালান বন্ধ করা অন্তর্ভুক্ত থাকবে কিনা, সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে জার্মানির চ্যান্সেলর এ সপ্তাহে নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানা গেছে।
বার্লিনে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত রন প্রসোর জার্মানির উদ্বেগ স্বীকার করলেও দেশটিকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি ম্যার্ৎজকে ‘বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাঁর সমালোচনা তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে নেন।
এদিকে, জার্মানিতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। সিভে সংস্থার সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় ৫১ শতাংশ জার্মান নাগরিক ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির বিরোধিতা করেছেন। বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশনের মে মাসের সমীক্ষা অনুযায়ী, মাত্র ৩৬ শতাংশ জার্মান এখন ইসরায়েলকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে, যা ২০২১ সালে ছিল ৪৬ শতাংশ। একই সমীক্ষায় দেখা যায়, মাত্র এক-চতুর্থাংশ জার্মান ইসরায়েলের প্রতি বিশেষ দায়বদ্ধতা অনুভব করে, যেখানে ৬৪ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করে জার্মানির এই বিশেষ বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *