শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ থেকে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। আজ রোববার বিকেল ৫টার কিছু আগে শুরু হওয়া সমাবেশ থেকে তিনি এই ইশতেহার ঘোষণা করেন। ইশতেহারে ২৪টি দফা উল্লেখ করেন নাহিদ।
ইশতেহারে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দলের জন্ম, এনসিপির জন্ম, আমাদের সকল শ্রম, আপনাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। আপনাদের অভিযোগ-অনুযোগ, প্রত্যাশা আমাদের ভাবনাকে করেছে গভীর, আমাদের লক্ষ্যকে করেছে সমৃদ্ধ। তাই ঠিক একবছর পর আমরা আবার শহীদ মিনারে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, একটি নতুন বাংলাদেশের, আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকের ২৪ দফা ইশতেহার ঘাষণা করছি।’
‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ শিরোনামে ২৪ দফাগুলো হলো–
১। নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক
২। জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার
৩। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার
৪। ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কার
৫। সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন
৬। জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
৭। গ্রাম পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকার
৮। স্বাধীন গণমাধ্যম ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ
৯। সার্বজনীন স্বাস্থ্য
১০। জাতিগঠনে শিক্ষানীতি
১১। গবেষণা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব
১২। ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিসত্ত্বার মর্যাদা
১৩। নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন
১৪। মানবকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি
১৫। তারুণ্য ও কর্মসংস্থান
১৬। বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নীতি
১৭। টেকসই কৃষি ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব
১৮। শ্রমিক-কৃষকের অধিকার
১৯। জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা
২০। নগরায়ন, পরিবহন ও আবাসন পরিকল্পনা
২১। জলবায়ু সহনশীলতা ও নদী-সমুদ্র রক্ষা
২২। প্রবাসী বাংলাদেশির মর্যাদা ও অধিকার
২৩। বাংলাদেশপন্থী পররাষ্ট্রনীতি
২৪। জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল
এতে বলা হয়, ‘পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে আমাদের রাষ্ট্রের নতুন যাত্রায় আমাদের প্রথম অঙ্গীকারই হচ্ছে গণপরিষদের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমাদের এই নতুন সংবিধান একনায়কতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ করে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনকল্যাণমুখী সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন করবে। আমাদের নতুন রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবন, জীবিকা, মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করবে। এই নতুন সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বিভাজন ও ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। আমরা জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করব।’
ইশতেহারে এনসিপি বলছে, ‘আমরা জুলাইয়ে সংঘটিত গণহত্যা, শাপলা গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে সংঘটিত সকল মানবতাবিরোধী অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করব। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করে আজীবন তাদের পাশে দাঁড়াব। জুলাইয়ের জাতীয় ঐক্য ও হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মহিমাকে ধারণ করার জন্য আমরা জুলাইয়ের স্মৃতি রক্ষা করব এবং সবসময় ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের সহযোদ্ধাদের পাশে থাকব।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা সংবাদমাধ্যমের শতভাগ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং যথাযথ আইনী ও নীতি কাঠামোর মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত করব। আমরা প্রেস কাউন্সিলকে যুগোপযোগী ও কার্যকর করব। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা করপোরেশনের কাছে যাতে বহু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কুক্ষিগত না হয়, রাজনৈতিক দলের স্বার্থের হাতিয়ার না হয়, বরং গণমাধ্যম জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, আমরা তার আইনি কাঠামো তৈরি করব। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা শক্তিশালী করার প্রয়াসে নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ অবারিত করতে নাগরিক সমাজের অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নীতি কাঠামো তৈরি করা হবে। আমরা গণমাধ্যমে মিসইনফরমেশন/ গুজব ও বিভ্রান্তিকর সংবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করব।’
ইশতেহারে বলা হয়, ‘আজ বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ বেকার, এদের প্রতি তিনজনের দুইজনই তরুণ। সকল কর্মক্ষম নাগরিকের জন্য দেশে ও বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমরা রপ্তানিমুখী শ্রমঘন-শিল্পের বহুমুখীকরণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলব। কর্মক্ষেত্রে প্রায়োগিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষাজীবনে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতনভুক্ত ইন্টার্নশিপের সুযোগ সম্প্রসারণ করব। প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নফাঁস, দুর্নীতি, সুপারিশ ও স্বজনপ্রীতি সম্পূর্ণ দূর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করব এবং গ্রেড ভিত্তিক সমন্বিত পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করব।
নাহিদ বলেন, ‘আমরা তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা-সহায়ক পরিবেশ তৈরি করব। আমরা জেলা-ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং ও রিমোট ওয়ার্ক হাব গড়ে তুলবো এবং পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, কো-ওয়ার্কিং স্পেস, ও উচ্চগতির ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করব। বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদ রপ্তানির লক্ষ্যে আইটি, স্বাস্থ্যসেবা, নার্সিং, ব্যবস্থাপনা, লজিস্টিক্স, হসপিটালিটি ও প্রকৌশল খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেব। এজন্য আমরা ওই সেক্টর ও দেশভিত্তিক সুনির্দিষ্ট দক্ষতা ও ভাষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলব। আমরা বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে বিভিন্ন কারিগরি পেশায় প্রশিক্ষণ ও সনদ প্রদানের আওতা বাড়াব এবং সেগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ করতে বিদেশী প্রত্যয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করব। তরুণদের মাদক ও অপরাধপ্রবণতা রোধে প্রতি জেলায় আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরি করব।’
বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নীতির ব্যাপারে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে রপ্তানির বহুমুখীকরণ এবং বিকল্প বাজারে প্রবেশাধিকারে বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে আমরা বিভিন্ন দেশ ও ব্লকের সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করব। আমরা গার্মেন্টসের বাইরে উচ্চ সম্ভাবনাময়, শ্রমঘন খাতগুলোতে বিনিয়োগ ও প্রণোদনা জোরদার করব, যেমন, চামড়া ও পাদুকা শিল্প, আসবাব ও হোম ডেকর, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য প্রভৃতি। পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন উচ্চ মূল্য সংযোজন খাত যেমন, ঔষধশিল্প, ইলেকট্রনিক্স, এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) প্রসারে বিশেষ নীতি সহায়তা প্রদান করব। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে দেশের ঔষধ শিল্পে সৃষ্ট সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেব। ব্যবসা সহজীকরণ, জ্বালানি নিরাপত্তা ও আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে বৈদেশিক বিনিয়োগের এক আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করব। আমরা ৫০ বছর মেয়াদী শিল্প উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে শিল্পখাতের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করব। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য আমরা আমাদের তুলনামূলক সুবিধার (কম্পারেটিভ এডভান্টেজ) শ্রমঘন খাতগুলোতে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করব। আমরা চট্টগ্রাম, মংলা, মাতাবাড়ি বন্দরকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও আশেপাশের অঞ্চলের একটি লজিস্টিক হাব হিসেবে গড়ে তুলব। ইকো ট্যুরিজম তথা পর্যটন শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেব।’
এনিসিপির ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়, ‘আমরা মনে করি প্রবাসী বাংলাদেশিরা কেবল রেমিট্যান্সের উৎস নন, তাঁরা রাষ্ট্রের সম্মান, সংগ্রাম ও পুনর্গঠনের অন্যতম অংশীদার এবং বিদেশে বাংলাদেশের দূত। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে দেড় কোটির বেশি প্রবাসী অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, আমরা সেই অবদানকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব। আমরা প্রবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতে কাজ করব। কোন প্রবাসী শ্রমিক মারা গেলে তার মরদেহ হয়রানিমুক্তভাবে দেশে আনার ব্যবস্থা নেব এবং তার পরিবারকে সর্বপ্রকার সহায়তা প্রদান করব। প্রবাসীদের জন্য ভোটাধিকার, দূতাবাস ও বিমানবন্দরগুলোতে হয়রানি-মুক্ত সেবা, জরুরি সহায়তা তহবিল, দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ ও ডিজিটাল সরকারি সেবা নিশ্চিত করব। দেশে ফিরে আসা কিংবা সংকটে পড়া প্রবাসীদের জন্য থাকবে পুনর্বাসন ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত। আমরা মানবপাচার রোধ এবং বিদেশে বাংলাদেশী নাগরিকদের স্বার্থ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমরা একই সাথে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রবাসীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করব।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশের স্বার্থে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবসময় দলীয় স্বার্থ ও সংকীর্নতার উর্ধে থাকবে। এনসিপি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রক্ষার প্রশ্নে আপোষহীন থাকবে। আমরা পারস্পরিক সম্মান ও সম-মর্যাদার ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলবো এবং আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেকোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করব। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ও আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে পেতে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বোচ্চ পর্যায়ে দৃঢ় ভূমিকা নেয়া হবে। আমরা দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক কূটনীতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মানবিক সমাধান করব। আমরা মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রসমূহের সাথে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলবো। শান্তি, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা, ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সার্ক, আসিয়ান, ওআইসি, ন্যাম, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সক্রিয় অংশীদারত্ব গড়ে তোলা হবে। শুধু মাত্র স্টেট এক্টর নয়, প্রতিটা দেশের আন্ত যোগাযোগ ও তাদের ইনসাফ নিশ্চিতকরণে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসিকে গুরুত্ব দিবো। দক্ষিণ এশিয়া, গ্লোবাল সাউথসহ বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতি বাংলাদেশের থাকবে অকুণ্ঠ সমর্থন, সহযোগিতা ও সংহতি।’
সবশেষে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, ‘আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই শহীদ মিনারেই আমরা শপথ নিয়েছিলাম এই দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করব। আপনারা সেই আহ্বানে সাড়া দেয়ায় আমরা সবাই মিলে ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাজিত করেছি এবং দেশের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে নিয়েছি। আজ আবারও এই শহীদ মিনার থেকে আমরা আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি: আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনে এই ঐতিহাসিক ২৪ দফাকে বাস্তবে রূপান্তর করে সকল নাগরিকের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ি।’