নাফ নদীতে একের পর এক জেলে নিখোঁজ, কী হচ্ছে সেখানে?

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

কক্সবাজারের নাফ নদী এবং সংলগ্ন এলাকা থেকে একের পর এক বাংলাদেশী জেলে নিখোঁজ কিংবা অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এতে জেলেদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
গত এক মাসে এরকম কমপক্ষে এক শ’ জেলে নিখোঁজ হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় বোট মালিক ও মাছ ব্যবসায়ীরা। নিখোঁজদের স্বজনেরা বলছেন, মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি নাফ নদী থেকে বাংলাদেশী জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
নাফ নদী কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা সীমান্তে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে আলাদা করেছে।
নাফ নদী, সেই নদীর মোহনা এবং সেন্ট মর্টিন দ্বীপের দক্ষিণ সাগরে মাছ ধরেই মূলত: জীবিকা নির্বাহ করেন বাংলাদেশী জেলেরা। কিন্তু একের পর এক জেলেকে আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আতঙ্কে জেলেদের অনেকেই সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যদিও বাংলাদেশের কোস্টগার্ড বলছে, তাদের ভাষায়, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে কোনো আটকের ঘটনা ঘটছে না।
কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাহমুদুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, জেলেরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমারেখা অতিক্রম করার কারণে তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কিন্তু নাফ নদীকে ঘিরে হঠাৎ কেন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো?
আর বাংলাদেশী জেলেদের নিরাপত্তায় কোস্টগার্ড কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটাও এখন আলোচনায়।

জেলেদের কী অভিজ্ঞতা?
গত ২৬ আগস্ট টেকনাফের শাহপরী দ্বীপের বাসিন্দা রশিদ আহমেদের ছেলেকে তার চোখের সামনেই নাফ নদী থেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। দশ দিন আগের সেই ঘটনার সময় রশিদ আহমেদ নিজেও মাছ ধরতে গিয়েছিলেন নদীতে।
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ দেখি স্পিড বোটে করে আরাকান আর্মি আসতেছে। আমি ছিলাম অন্য নৌকায়। আমার ছেলেসহ তারা ছিল আরেকটা নৌকায়। ওরা স্রোতের টানে একটু দূরে চলে গেছিল। আমরা পালিয়ে আসতে পারলেও ওরা পারে নাই। স্পিড বোট আসি ধরি ফেলাইছে।’
রশিদ আহমেদ বলছেন, স্পিডবোটে আসা সবার হাতেই অস্ত্র ছিল।
‘হাতে বন্দুক ছিল। পুলিশের মতো ড্রেস সবার, রঙ গাছের পাতার মতো,’ বলেন তিনি।
সেদিন আরাকান আর্মি নৌকাসহ ধরে নিয়ে যায় পাঁচজনকে।
আটমাসের অন্তসত্ত্বা পারভীন বেগমের স্বামীও ছিলেন সেই পাঁচজনের একজন।
তার নাম ইমাম হোসেন। ইমাম হোসেনের স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবিসিকে বলেন, তার স্বামী এবং অন্যরা বেঁচে আছে না কি মরে গেছে, তারা জানেন না। কোনো খোঁজ-খবরও পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে পাঁচ জেলে নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পর মিয়ানমারের একটি ওয়েবসাইটে ইমাম হোসেনসহ অন্য জেলেদের ছবি প্রকাশিত হয়।
যেখানে বলা হয়, ‘মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়ায়’ আরাকান আর্মি তাদের গ্রেফতার করেছে।
মোবাইলে সেই খবরে আটক পাঁচ জেলের ছবি দেখিয়ে ইমাম হোসেন ও অন্যদের পরিচয় শনাক্ত করেন স্বজনেরা।
আরাকান আর্মি জেলেদের কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে?
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন মূলত চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নাফ নদীর মোহনাসহ বিভিন্ন স্থানে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। জেলেদের অপহরণের ঘটনাও বাড়ে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি আরাকান আর্মির হাতে আটক হয়েছিলেন শাহপরী দ্বীপের জেলে আব্দুর রহমান। আট দিন পর বিজিবির মাধ্যমে তাকে ফেরত দেয় আরাকান আর্মি।
আব্দুর রহমান বিবিসিকে বলছিলেন, তাকেসহ যেসব জেলেকে তখন ধরা হয়েছিলো, তাদেরকে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়ার অভিযোগ আনে আরাকান আর্মি।
তিনি বলেন, ‘ওরা বলতেছিল যে তোমরা মিয়ানমার সীমানায় কেন মাছ ধরতে আসছো? আমরা তো জানি না এটা মিয়ানমারের সীমানা। আমরা তখন মাছ ধরতে গেছিলাম। আমরা তো মনে করছি, এটা বাংলাদেশের সীমানা। কিন্তু ওরা বলতেছিল, আমরা ওদের এলাকায় ঢুকে গেছি।’
পরে আব্দুর রহমানসহ নৌকায় থাকা জেলেদের হাত-পা বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমারে আরাকান আর্মির আস্তানায়। সেখানে বদ্ধ ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় সাত দিন। অষ্টম দিনে তাদের ফেরত দেয়া হয় বিজিবির মাধ্যমে।
নদী থেকে ধরে নেয়ার সময় বাংলাদেশের কোস্টগার্ড আশেপাশে ছিল কি না এমন প্রশ্নে আব্দুর রহমান জানান, ‘কোস্টগার্ড ছিল। কিন্তু ওরা আমাদের দেখতে পায় নাই। কারণ আমরা অনেক দূরে চলে আসছিলাম।’
পরিবারগুলো জানে না তাদের নিখোঁজ স্বজনেরা কবে ফিরবেন কিংবা আদৌ ফিরতে পারবেন কি না। কিন্তু আরাকান আর্মি কেন জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে?

জেলেরা কিভাবে নিখোঁজ হচ্ছেন?
নাফ নদী এবং সাগরে নিরাপত্তা দেখভাল করে কোস্টগার্ড। নৌপথে কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল কার্যক্রমও চলে।
কিন্তু এই টহল কার্যক্রমের মধ্যেই একের পর এক বাংলাদেশী জেলে কিভাবে নিখোঁজ হচ্ছেন কিংবা আরাকান আর্মি তাদের কিভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
যদিও কোস্টগার্ড বলছে, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে কেউ আটক বা নিখোঁজ হচ্ছে না।
কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা তো আমাদের জলসীমায় কার্যক্রম পরিচালনা করি। বেশিরভাগ সময় দেখেছি, জেলেরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার যে সীমারেখা আছে, সেই সীমারেখা অতিক্রম করার কারণে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বেশি মাছ ধরার আশায় অথবা অসাবধানতাবশত: তারা বাংলাদেশের সীমারেখা অতিক্রম করছে।’
কোস্টগার্ড এ কথাও বলছে, বাংলাদেশের জলসীমা ঘিরে টহল কার্যক্রম ‘আরো জোরদার করা হয়েছে’। কোথায় মাছ ধরা ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো জানানো এবং সীমান্ত রেখা অতিক্রম না করতে সতর্ক করা এবং কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।
এরমধ্যেই গত ২৯ আগস্ট নাফ নদীর মোহনা ও সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১২২ জন জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। সেসময় বাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্যে জানানো হয়েছিল, এসব জেলেরা বাংলাদেশের সীমারেখা অতিক্রম করে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকেছিলেন।

জেলেরা কেন মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকছেন?
জেলেদের কেউ কেউ যে বাংলাদেশের সীমারেখা পেরিয়ে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়ছেন এর নানা কারণ আছে।
কোস্টগার্ড বলছে, অসাবধানতা এবং বেশি মাছ পাওয়ার আশায় এরকমটা ঘটছে।
তবে এর বাইরে আরো দু’টি কারণের কথা বলছেন জেলেরা। এর একটি হচ্ছে, নাফ নদীর মোহনায় নাইক্ষংদিয়া এলাকায় ডুবোচরের কারণে বাংলাদেশ অংশে পানির গভীরতা কমে গেছে। কিন্তু মিয়ানমারের জলসীমা ঘেঁষে পানির গভীরতা বেশি থাকায় অনেকে সেই পথ দিয়ে যাতায়াত করেন।
আরেকটি কারণ হচ্ছে, মাছ ধরার সময় তীব্র স্রোতে কখনো কখনো নৌকা ভেসে মিয়ানমারের অংশে চলে যায়।
টেকনাফ পৌর বোট মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমেদ বলেন, ‘আগেও বিভিন্ন সময় বাস্তবতার কারণে এমনটা হয়েছে। কিন্তু তখন মিয়ানমার আটকায় নাই। এখন আরাকান আর্মি আসার পরে কড়াকড়ি শুরু করেছে।’

নেপথ্যে কারণ কী?
বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সীমান্তের দখল নেয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, জেলেরা এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা এমনটাই বলছেন।
তবে আরাকান আর্মি যে শুধু মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকলে বাধা দিচ্ছে কিংবা আটক করছে তেমনটা নয়।
বাংলাদেশী জেলেদের কেউ কেউ দাবি করছেন, আরাকান আর্মির সদস্যরা অতীতে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকেও জেলেদের ধরে নিয়ে গেছেন।
এদিকে আরাকানের বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নাফ নদী কিংবা সাগরে আরাকান আর্মির বিভিন্ন অভিযানের খবর, ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।
এরকম কিছু ভিডিও এবং ছবি ঘেঁটে দেখা যায়, আরাকান আর্মির সদস্যরা স্পিড বোটে করে জেলেদের নৌকাকে ধাওয়া করছেন।
পরে মিয়ানমারের জলসীমায় অনুপ্রবেশের দায়ে নৌকা এবং জেলেদের আটকের ছবি এবং ভিডিও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
এরকম কয়েকটি ছবি ও ভিডিওতে যেসব জেলেকে দেখা গেছে, তাদের অনেককেই আবার বাংলাদেশের জেলে বলে শনাক্ত করেছেন স্বজনেরা।
যদিও এসব জেলে নৌকা মিয়ানমার না কি বাংলাদেশের জলসীমা থেকে আটক হয়েছে, সেটা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি।
তবে জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে আরাকান আর্মির তৎপরতার কারণে অনেকে জেলেই এখন নাফ নদীর গভীরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন না।
গত এক মাসে অন্তত এক শ’ জেলে নিখোঁজ হওয়ার পর আরাকান আর্মি যে সীমান্তে তৎপরতা বাড়িয়েছে সেটা স্পষ্ট। যেটাকে জেলেরা দেখছেন, অনেকটা ‘আক্রমণাত্মক’ অবস্থান হিসেবে।
কিন্তু আরাকান আর্মির হঠাৎ এমন ‘আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার’ কারণ কী?
নিরাপত্তা বাহিনী সংশ্লিষ্ট এবং স্থানীয়রা এখানে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করছেন।
প্রথমটি হচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার বিদ্রোহীদের কাছ থেকে আরাকানের দখল নিতে চেষ্টা করছে। সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের জঙ্গি বিমান উড়তে দেখেছেন বলেও দাবি করছেন বাংলাদেশী জেলেরা। সবমিলিয়ে নৌপথে সরকারি বাহিনীর হামলার আশঙ্কায় নদী ও সাগরে কড়া নজরদারি করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
দ্বিতীয়টি কারণটি হচ্ছে, জেলেদের নৌকা আটকের পর লাখ লাখ টাকার মাছ, জাল, খাবার ও অন্যান্য সরঞ্জাম দখল।
আর তৃতীয়টি হচ্ছে, জেলেদের আটকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে একধরনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন, ব্যবসা পরিচালনা এবং এর মাধ্যমে একধরণের বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের পরোক্ষ চেষ্টা করছে আরাকান আর্মি।
টেকনাফের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও এই ধারণা জোরালো হয়েছে।
যদিও এসব বিষয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। কোস্টগার্ড দাবি করছে, বাংলাদেশের জলসীমার ভেতর থেকে জেলেদের আটক করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে না। কারণ জেলেদের নিরাপদে মাছ ধরা নিশ্চিত করতে কোস্টগার্ডের জোরদার নিরাপত্তা কার্যক্রম রয়েছে।
তবে কারণ যেটাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশী জেলেরা একের পর এক আটক হচ্ছেন এবং এক শ’ জেলে আটক হওয়ার পর তাদের খোঁজ কিংবা ফেরত আনাও যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ জানতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য চাওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে রাখাইনে নির্দিষ্ট বৈধ কোনো সরকারের অস্তিত্ব না থাকায় জেলেদের ফিরিয়ে আনা সময়সাপেক্ষ হতে পারে।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *