পাকিস্তান কি বাংলাদেশের ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার দেবে?

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

ঢাকায় ১৫ বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে পাওনা ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার ফেরত চাওয়া হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এই পাওনা নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রস্তুত করেছে। ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ থেকে ন্যায্য হিস্যা হিসাবে এই ৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা বলছেন এই দাবি বাংলাদেশ আগেও করেছে, কিন্তু অর্থ পাওয়া যায়নি। তবে দাবি অব্যাহত রাখতে হবে। আর পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক গ্রুপ সানোবার ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. কামার চিমারের কথায়, যদি বাংলাদেশের দাবি যৌক্তিক হয়, তাহলে পাকিস্তানের উচিত হবে বাংলাদেশের পাওনা দিয়ে দেওয়া।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ বুধবার ঢাকায় এসেছেন। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হবে। বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন। ২০১০ সালের পর বাংলাদেশে এটি হবে কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুত্র জানিয়েছে, উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। তবে কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা নির্ধারণ করা না হলেও আলোচনার সময় পারস্পরিক স্বার্থের সকল বিষয়ই আলোচনায় আসবে।
পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. ইকবাল হোসেন খান এই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য বর্তমানে ঢাকায় আছেন। তিনি সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসকে বলেছেন, ইসলামাবাদ ঢাকার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে আগ্রহী।’
তিনি বলেন, পাকিস্তান, বিশেষ করে তাদের পণ্যের দাম প্রতিযোগিতামূলক বিবেচনায় বাংলাদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছে। তুলাকে প্রধান পণ্য হিসেবে উল্লেখ করে পাকিস্তান তুলা সরবরাহ করতে আগ্রহী।
হাইকমিশনার বলেন, পাকিস্তান যেহেতু আফগানিস্তান ও ইরান থেকে পণ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে, তাই পরিবহণ খরচ কম হলে বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানের মাধ্যমে আমদানি করার সুযোগ রয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এই মাসের শেষের দিকে ঢাকা সফর করবেন। ২০১২ সালের পর বাংলাদেশে এটি হবে কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।

সম্পর্কের দুয়ার খুলছে?
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের দুয়ার খুলতে থাকে। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি শুরু হয়। পাকিস্তানের পণ্যবাহী জাহাজ আসে চট্টগ্রাম সমূদ্র বন্দরে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, পাবিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ভালো সম্ভাবনা আছে। তবে সেটা একপাক্ষিক। আমরা আমদানি করি বেশি। চিনি, তুলা, রঙ আমদানির ভালো সম্ভাবনা আছে। কানেক্টিভিটির একটা ভালো সম্ভাবনা আছে, দুই দেশই লাভবান হবে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়বে। সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা গেলে, ভারত যদি রাজি হয়, তাহলে আঞ্চলিক সহযোগিতার একটা ভালো সম্ভাবনা আছে।
আর রাজনৈকিভাবে এতদিন ভালো সম্পর্ক ছিল না এখন ভালো হচ্ছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। আমাদের স্বার্থের দিকে নজর রেখেই সম্পর্ক করতে হবে। পাকিস্তান অনেক কিছু চাইতে পারে, ভারত অনেক কিছু চাইতে পারে। কিন্তু আমরা কতটা দিতে পারব কী পারবো না, সেটা আমাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই সম্পর্ক ঠিক করতে হবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, বলেন তিনি।
আরেকজন সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, গত ১৫ বছরে আমাদের সব সম্পর্ক দিল্লির মাধ্যমে হতো। পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে যে মেজর ইস্যু সেগুলো আমরা ডিল করতাম দিল্লির মাধ্যমে। আমি এখন পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে এখন একটা স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির চেষ্টা হিসাবে দেখছি। এটা আমার কাছে ইতিবাচক। আমাদের পরারাষ্ট্র নীতির একটা স্বাধীন শিফট হচ্ছে। দিল্লির প্রভাবমুক্ত। এটা আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে।
আর পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক গ্রুপ সানোবার ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. কামার চিমার ডয়চে ভেলেকে বলেন, পাকিস্তান মনে করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন এসেছে। বিগত সময়ে আন্তরিক আলোচনার পরিবেশ ছিল না। এখন ঢাকার যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বড় সুযোগ করে দিয়েছে। আর দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য আমি গভীর আগ্রহ দেখছি।
‘ভারত যেভাবে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে, যেমন ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল। প্রফেসর ইউনূস চীনে গিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার নিয়ে মন্তব্য করার পর ভারত বাংলাদেশকে অর্থনীতিসহ নানা দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। তাই বাংলাদেশের এখন পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত হওয়ার অনেক সুযোগ আছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব এখন ঢাকায়। এরপর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যাবেন। ফলে সম্পর্ক আরও বাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভোটে নির্বাচিত নয়। ফলে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে তারাই আসলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ধারণ করবেন।’

বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন র্পূব পাকিস্তানের জন্য পাঠানো ২০ কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তা অন্যতম। এছাড়া আছে বিদেশি ঋণ যা বাংলাদেশে ব্যয় হয়নি কিন্তু স্বাধীনতার পর দায় নিতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বহু বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও সঞ্চয়পত্রের অর্থ ফেরত দেয়নি।
এর পাশাপাশি অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ থেকে প্রায় ৪.৩২ বিলিয়ন ডলারের ন্যায্য হিস্যার দাবিও বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে করে আসছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতেই অবিভক্ত পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশের অংশীদার ছিল বাংলাদেশ। বিদেশি মুদ্রা আর্জনে বাংলাদেশের অবদান ছিল ৫৪ শতাংশ। আর যেকোনো সমতার নীতি অনুসরণ করলেও বাংলাদেশ অন্তত ৫০ শতাংশ দাবি করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তার একটি হিসাব তৈরি করেছে যা দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে উঠতে পারে।
কামার চিমার বাংলাদেশের পাওনার প্রশ্নে বলেন, আমার মত হলো, পাকিস্তানকে বাংলাদেশের পাওনাদাওনার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। আর এটা নিয়ে পরিস্কার আলাপ আলোচনা হওয়া দরকার। ঢাকায় আশা করি আলাপ হবে। পাকিস্তানে হতে পারে। বাংলাদেশের যে দাবি তা ঠিক হলে অবশ্যই পাকিস্তানের সেটা পরিশোধ করা উচিত। আমার কথা, ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার বড় কথা নয়, দুই দেশের সম্পর্ক বড়। পাকিস্তানকে সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।
আর মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, ১৯৭১ সালের আগে যে বিদেশি ঋণ এসেছিল অবিভক্ত পাকিস্তানে। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ আরো ডেনারদের ঋণ ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ঋণের দায় আমাদের ওপর এলো। এটা কিন্তু যৌক্তিক না। ওই প্রকল্পগুলো কিন্তু আমাদের এখানে বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়ন হলে কথা ছিল। সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে নানা মত থাকতে পারে। আমরা যা দাবি করি, তারা তার সঙ্গে দ্বিমত হতে পারে। কিন্তু আমরা তো পাবো। আর লোনের টাকা তো ডকুমেন্টেড। আমার মনে হয় পাকিস্তানের উচিত আমাদের দাবি বিবেচনায় নেওয়া।
এম হুমায়ুন কবিরের কথায়, এই দাবি আমরা আগেও করেছি। কিন্তু পাকিস্তান দেয়নি। তারপরও আমাদের দাবি জানিয়ে যেতে হবে। আমাদের সম্পদ তো আমরা চাইবোই।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালে মাহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি গণহত্যার জন্য পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ক্ষমা চায়নি। বাংলাদেশের মানুষের একটা প্রত্যাশা যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইবে। একাত্তরে তাদের যে ভূমিকা সেটার দায় তারা গ্রহণ করবে। সেটা হলে দুই দেশের সম্পর্কের পথ আরো প্রশস্ত হবে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *