সুদান : প্রচারহীন এক গণহত্যার উপাখ্যান

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

সুদানে সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া নৃশংস গৃহযুদ্ধ এখন দুই বছর অতিক্রম করেছে। এই সংঘর্ষ এখন শুধু সামরিক পর্যায়েই থাকেনি। বরং রূপ নিয়েছে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে। বিশ্বের যেসব বিপর্যয় গণমাধ্যমে কম কভারেজ পেয়েছে, সুদানের সঙ্কটটি এর মধ্যে অন্যতম। অথচ এই সঙ্কটে ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। বহু অঞ্চল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে গোটা জাতি। এর মধ্য দিয়ে সুদান হয়ে ওঠেছে প্রচারহীন এক গণহত্যার উপাখ্যান।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুদানে যুদ্ধ চলাকালে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। অসংখ্য মানুষ যুদ্ধ, রোগ এবং দুর্ভিক্ষের কারণে প্রাণ হারিয়েছে। দেশজুড়ে চরম অপুষ্টি এবং জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে। যুদ্ধের ফলে পূর্ব ও মধ্যাঞ্চল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল অধিকাংশই আরএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। বিশেষ করে খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা, নির্বিচারে মানুষ হত্যা এবং বিচারবহির্ভূত নির্যাতন এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আরএসএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আরো গুরুতর। তারা পশ্চিম দারফুরে চালাচ্ছে গণহত্যা। সংঘবদ্ধ করছে নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ, পুরো সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে করছে পরিকল্পিত হামলা।
এই সঙ্ঘাত প্রথম দিকে ছিল দুই সশস্ত্র বাহিনীর লড়াই। কিন্তু এখন তা সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে এক বর্বর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধকবলিত মানুষের ব্যক্তিগত কণ্ঠে এসব নির্মম বাস্তবতা শোনা যাক।

জয়নাব (৩৪)
তিনি দক্ষিণ দারফুরের বাসিন্দা। এখন আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী এক দেশে। তিনি জানান, যুদ্ধের আগে ঈদের দিন ছিল আনন্দের সময়। পরিবার-পরিজনের সাথে হতো মিলনমেলা। এখন আমাদের পরিবার সাতটি ভিন্ন ভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। নিয়ালার সেই দিনগুলো—ঘুরে বেড়ানো, সামাজিকতা, কফির আড্ডা—সবই আজ অতীত। যুদ্ধের বিভীষিকা তাকে আজ একা করে দিয়েছে। পরিবার হারানোর ভয় তাকে প্রতিদিন তাড়া করে বেড়ায়।

মন্তাসার (৩০)
তিনি শার্ক এল-নাইলের বাসিন্দা। আরএসএফ-এর অভিযানে চাচাতো ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। সাথে আরো তিনজন। তারা কেবল চা খাচ্ছিলেন। যুদ্ধের আগেই তিনি ‘দুক্কান্না‘ নামের একটি সমাজ উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সক্রিয় ছিলেন। এই সংগঠনটি স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র মেরামতে অনুদান দিতো। সেই সুদিন এখন আর নেই।

মুসা (৪০)
তিনি ছিলেন খার্তুমের বাসিন্দা। সেখান থেকে পালিয়ে তিনি প্রতিবেশী এক দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ২০১৯-এর গণআন্দোলনের সময়ের ‘স্বাধীনতা, শান্তি ও ন্যায়বিচার’ এর স্লোগান এখন তার শুধুই স্মৃতি। আজ তিনি তার আশ্রয়, জীবিকা, এমনকি আশাও হারিয়েছেন। পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করতে নিজের লেবু গাছ কাটতে বাধ্য হয়েছেন। যুদ্ধকে তিনি দেখছেন গোটা জাতির ওপর এক অভিশাপ হিসেবে।

ইয়াসের (৪৫)
তিনি ওয়াদ মাদানী থেকে গেদারেফে আশ্রয় নিয়েছেন। ঈদ উদযাপন, পরিবারের সাথে ভোজ, হাসপাতালের সহকর্মীদের সাথে সময় কাটানো এবং সন্তানদের সাথে পার্কে সময় কাটানো ইত্যকার স্মৃতি আজ তার চোখকে টলমলে করে তোলে। একদিন হঠাৎ সেনাবাহিনী শিবিরে প্রবেশ করলে সবাইকে দৌড়ে পালাতে বলা হয়। যেটুকু বহন করা যায়, তা নিয়ে জীবনের নিরাপত্তায় ছুটে যান গ্রামাঞ্চলে।

আবু বকর (৩৫)
তিনি এল-জেনিনা থেকে চাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ২০০৩ সালে জানজাউইদের হামলায় এল-জেনিনায় পালিয়ে যাওয়া তার জীবনের প্রথম বাস্তুচ্যুতি। ২০২৩ সালের ১৫ জুন আরএসএফ গভর্নরকে হত্যা করলে আবার পালাতে হয়। পথে আরএসএফ-এর হামলায় তার সঙ্গীদের কেউ কেউ নিহত হন। অনেক হন আহত। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে চাদ পৌঁছালেও প্রতিটি মুহূর্ত ছিল মৃত্যুভয়ের সাথে যুদ্ধ।
সুদানের জনগণের এই দীর্ঘ, নীরব যন্ত্রণা বিশ্বের কাছে প্রায় অদৃশ্য। অথচ বাস্তবতা ভয়াবহ। লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুতি, দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ, বিচ্ছিন্ন পরিবার এবং চূড়ান্ত হতাশা। এই রিপোর্টে উঠে এসেছে সেসব কণ্ঠস্বর, যাদের না বলা গল্প বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হওয়া উচিত।
এই যুদ্ধ শুধু একটি দেশের নয়, মানবতার পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি। সুদান এখন কেবল একটি দেশের নাম নয়। এটি প্রচারহীন এক গণহত্যার উপাখ্যান।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *