শেষ পর্যন্ত তুমি চলেই গেলে !

-কাজী মোঃ হাসান

( আজ ৩০ এপ্রিল। তোমার চলে যাবার দিন।
হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।
তা কেমন আছো তুমি? ভালো তো?)

শেষ পর্যন্ত তুমি চলেই গেলে
আমাকে একলা ফেলে!
কিন্তু কেন? কি হয়েছিলো তোমার
আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি,গালি দিয়েছি
হাত তুলেছিলাম তোমার গায়ের উপর
হাতটা ভেঙ্গে দিয়েছি, পা, চোখ অন্ধ করে দিয়েছি
তাহলে তুমি কেনো গেলে, কোথায়ই বা গেলে,
আমাকে একলা ফেলে!

মগ ভর্তি করে চা খেতে তুমি
ঠান্ডা হলে চুলাতে বসিয়ে আবার গরম করে নিতে
কত নিষেধ করেছি কিন্তু পাত্তা দাওনি।
ডায়াবেটিসটা তোমাদের বংশগত
ছিল কি-না জানিনা
বিয়ের দশ বছরও পার হয়নি
জাপটে ধরেছিলো অসুখটা।
অথচ ডায়াবেটিসকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে
ডাক্তারদের পরামর্শ উপেক্ষা করে
যা খুশি তাই খেয়ে যেতে।
চলা-ফেরায়ও ছিলো ইচ্ছের বাহাদুরি
এক হাতও হেঁটে দেখোনি কোনদিন
কিন্তু তুমি একবারও ভেবে দেখোনি
আসলে মানুষ প্রকৃতির দাস।
অথচ আজ এই প্রকৃতির কাছেই
তুমি হেরে গেলে, সবকিছু ছেড়ে চলে গেলে
আমাকে একলা ফেলে!

জানি, তোমার সাহস ছিল অনেক
জেদটাকেও ভয় পেতো অনেকেই
নির্ভয়ে কথা বলতে পারতে
যেখানে সেখানে।
অহংকারকে দূরে ঠেলে সহজেই
সবার হয়ে যেতে পারতে যখন তখন
হয়তো এজন্যই ইচ্ছেরা ছিল তোমার পদানত।
এতো যে তোমার ক্ষমতা,এতো আত্মবিশ্বাস
এ সব আজ কোথায় রেখে গেলে, কার কাছে?
একজন ক্লান্ত শ্রান্ত শান্ত পথিকের মতো
চুপচাপ চলে গেলে
কেন গেলে, আমাকে একলা ফেলে!

ডায়াবেটিস এবং কিডনির লেভেলটা
অনেক আগেই অতিক্রম করেছিলো তোমার
অবস্থাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে
ডাকা হলো ডাক্তার
তিনি দেখলেন ওষুধ দিলেন
আমি প্রাণ-পণ যত্ন করে গেলাম
বলা ভালো, আমি ছাড়া তো তোমার পাশে কেউ
ছিলোনা তখন।

হাসপাতালের সাহায্য নিতে বাধ্য হলাম আমি।
ডাক্তার সাহেবরা কি বুঝলেন কে জানে
তোমাকে সোজা ঠেলে দিল”আই সি ইউ ” তে
সেখানেই তারা আমার কনসেন্ট ছাড়াই
তোমাকে ফ্লুইড দেয়া হলো।
ফুলে ঢোল হয়ে গেলো তোমার হাত-পা মুখ
আঙ্গুলের ডগা। অথচ এই হাসপাতালে ফ্লুইড
বের করা বা ডায়ালিসিসের কোন ব্যবস্থা নেই।
হাসপাতালে ভর্তির আগে
যে নিজেই উঠে বসতে পারতো
চলতে পারতো, কথা বলতে পারতো
এখন তার চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেছে
হাতটা উঠাতে পারছে না,
পা টাও নাড়তে পারছে না অন্যের সাহায্য ছাড়া
মুখের কথাও বন্ধ হয়ে গেলো অবুঝ শিশুর মতো
ডাক্তারদের এই আচরণ আমাকে
অবাক করেছে-
এটা ভুল, না টাকার জন্য মানুষ নিয়ে খেলা
আমি বুঝিনি আজো?

তারপর কতো চিকিৎসা, কত দেশ ঘুরাঘুরি
কিন্তু তোমাকে আর ফেরানো গেলো না
তুমি চলে গেলে
অনেকটা অভিমান করেই যেনো তুমি চলে গেলে
আমাকে একলা ফেলে!

মনে আছে, প্রায়ই আমরা বসে বসে তর্ক করতাম
কার আগে কে যাবে-
তুমি বলতে আমি
আমি বলতাম আমি
ভেবে দেখো তো কোনটা সত্যি হলো?
তুমি হয়তো ভাবছো বেঁচে যখন আছি তখন
নিশ্চয়ই খুব সুখে আছি, ভালো আছি আমি!

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমি সুখে আছি।
ভালো আছি, রাজ রাজাদের মতো আছি।
ছেলে বিদেশে, মেয়ে শশুর বাড়ি
কাজের বুয়াটা দু’টো ভাত রান্না করে
দশটাতেই বিদায়।
তারপর চলে আমার বাহাদুরি
এ রুম থেকে ও রুমে যাই, সেখান থেকে অন্যরুমে।
সব ফাঁকা‌,কথা বলারও কেউ নেই
শার্ট প্যান্ট, বেড কভার এটা ওটা সব পড়ে আছে
এলোমেলো ভাবে। পড়ে আছে যেখানে সেখানে
কেউ কিছু বলার নেই
কারো কিছু করারও নেই ।
যেন আমি এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা
এর চেয়ে শান্তি আর কি-ই বা আছে?
কোথায় আছে?
না, না, দুনিয়াতে তো নেই-ই।

তবে কখনো কখনো একটু বিপত্তি ঘটে বৈকি
বয়স হয়েছে তো-
মাঝে মাঝে ওভেনে খাবার গরম করে,
বাসন-কোসন ধোয়ে খেতে বড় কষ্ট হয়,
একদম ইচ্ছে করেনা
তাই খাওয়াটাও হয় না।
আবার কখনো দেখি ভাত বা তরকারিগুলো
মনের ভুলে ফ্রিজে না রাখায় সব নষ্ট হয়ে গেছে
তীব্র দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে ওগুলো থেকে ।
সুতরাং বাধ্য হয়েই নির্জলা উপোস।
না, না, কারো বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছি না
শুধু নিজের অবস্থান তুলে ধরছি মাত্র।
তবুও তো আমিই খুব ভালো আছি, সুখে আছি।
তুমি কি বলো? ভালো নেই?

তবে হ্যাঁ, তাড়াহুড়ো করতে গেলেই
বড্ড গোলমাল বেঁধে যায়
ঘড়িটা পাই তো চশমাটা নেই, মোজাগুলো
ধোয়া হয়নি,শার্টগুলো কুচকে আছে
একটাও ইস্ত্রী করা নেই
তার উপর মাঝে মাঝে দেখা যায় বোতাম ছেড়া।
মানিব্যাগটা কোথায় যে রেখেছি
কে জানে!

তাই গলা ছেড়ে চিৎকার করে
কতদিন ডেকেছি তোমায়-
“এই যে শুনছো, কোথায় গেলে তুমি?
শিগগির এসো-
আমি চশমাটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না
মানিব্যাগটাও নেই, কোথায় যে রাখো না এসব!
ওগো শুনছো, বলি শুনছো-”
তবু উত্তর নেই
উত্তর না পেয়ে গলার স্বরটা আরো
বেড়ে উঠে যেতো উচ্চগ্ৰামে-
“এই যে শুনছো, আমি কি বলছি শুনছো
শিগগির এদিকে একটু এসো
আমি তো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা,
না মানিব্যাগ না চশমাটা, কিছুই না….
কিচ্ছু না ! তুমি শিগগির এসো,
আমি কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা……
পাচ্ছি না কিন্ত…..…!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *