শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
গত সপ্তাহান্তে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় দেশটির পরমাণু কর্মসূচির মূল অংশ ধ্বংস হয়নি এবং এতে মাত্র কয়েক মাসের জন্য ইরানের পরিকল্পনা পিছিয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রাথমিক গোয়েন্দা মূল্যায়নে উঠে এসেছে। এই মূল্যায়ন সম্পর্কে জানা সাতজন সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পেন্টাগনের গোয়েন্দা শাখা ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ) এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে, যা এর আগে প্রকাশিত হয়নি। সূত্রদের এক কর্মকর্তা বলেছেন, হামলার পর ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড যে যুদ্ধের ক্ষতি মূল্যায়ন করেছিল, তার ভিত্তিতে এই বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
হামলার প্রভাব ও ক্ষতি নিয়ে এখনো মূল্যায়ন চলছে এবং নতুন গোয়েন্দা তথ্য আসার পর এতে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে প্রাথমিক এই ফল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যিনি বারবার বলেছেন যে হামলায় ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সুবিধা ‘সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস’ হয়ে গেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথও স্থানীয় সময় রোববার (২২ জুন) বলেছিলেন যে, ইরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ‘ধূলিসাৎ হয়ে গেছে’।
মূল্যায়ন সম্পর্কে জানা দুই সূত্র বলেছেন, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ ধ্বংস হয়নি। এক কর্মকর্তা বলেছেন, সেন্ট্রিফিউজগুলো বেশিরভাগই ‘অক্ষত’ রয়েছে।
আরেক সূত্র বলেছেন, হামলার আগেই ইরান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সুবিধাগুলো সরিয়ে নিয়েছিল।
ওই সূত্রের দাবি, ‘ডিআইএ-এর মূল্যায়ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে, সর্বোচ্চ এইটুকুই।’
হোয়াইট হাউস এই মূল্যায়নের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে, তবে তারা এর সঙ্গে একমত নন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কেরোলাইন লেভিট সিএনএনকে একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই তথাকথিত মূল্যায়ন সম্পূর্ণ ভুল এবং এটি ‘টপ সিক্রেট’ শ্রেণিভুক্ত ছিল, তবুও গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের এক নিম্নস্তরের ব্যক্তি এটি সিএনএনকে লিক করেছে। এই মূল্যায়ন ফাঁসের পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য হলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হেয় করা এবং সেই সাহসি ফাইটার পাইলটদের অবমূল্যায়ন করা, যারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের জন্য নিখুঁত মিশন সম্পাদন করেছেন। সবাই জানে যখন আপনি ৩০ হাজার পাউন্ডের চৌদ্দটি বোমা সঠিক লক্ষ্যে ফেলেন, তখন কী হয়: সম্পূর্ণ ধ্বংস।’
তবে মার্কিন সামরিক বাহিনী বলেছে, অপারেশনটি পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে এবং এটি একটি ‘অপ্রতিরোধ্য সাফল্য’।
হামলার প্রভাব সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে এখনো সময় প্রয়োজন এবং কোনো সূত্রই বলেনি যে, অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার তুলনায় ডিআইএ-এর মূল্যায়ন কতটা ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র ইরান থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে, যার মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়নও অন্তর্ভুক্ত।
মার্কিন সামরিক অপারেশনের আগে কয়েকদিন ধরে ইসরাইল ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল, তবে তারা দাবি করেছিল যে ইরানের সুবিধা সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার পাউন্ডের বাঙ্কার বাস্টার বোমা প্রয়োজন। মার্কিন ‘বি-২ বোমারু বিমান’ ফোর্দো জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্লান্ট ও নাতানজ সমৃদ্ধকরণ কমপ্লেক্সে এই বোমা ফেললেও, সূত্রদের মতে, এতে সেন্ট্রিফিউজ ও উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি।
সূত্র থেকে জানা যায়, ফোর্দো, নাতানজ ও ইসফাহান—এই তিন স্থানেই ক্ষতি মূলত ভূমির ওপরের কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ অবকাঠামো এবং ইউরেনিয়ামকে বোমা তৈরির জন্য ধাতুতে পরিণত করার ভূমির ওপরের সুবিধা।
মার্কিন হামলার প্রভাব নিয়ে ইসরাইলের মূল্যায়নেও ফোর্দোতে প্রত্যাশার চেয়ে কম ক্ষতি পাওয়া গেছে। তবে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের ধারণা, একাধিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্মিলিত সামরিক অভিযান ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছে—যদি তারা বাধাহীনভাবে পুনর্নির্মাণ করতে পারে, যা ইসরাইল মানবে না। তবে মার্কিন সামরিক অপারেশনের আগেই ইসরাইল প্রকাশ্যে বলেছিল যে, ইরানের কর্মসূচি দুই বছর পিছিয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ সিএনএনকে বলেছেন, ‘আমরা যা দেখেছি, তার ভিত্তিতে বলছি—আমাদের বোমা হামলা ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। আমাদের বিশাল বোমাগুলো প্রতিটি লক্ষ্যে সঠিক স্থানে আঘাত করেছে এবং পুরোপুরি কাজ করেছে। সেই বোমার প্রভাব এখন ইরানের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে। সুতরাং, যে কেউ যদি বলে বোমাগুলো ধ্বংসাত্মক ছিল না, সে শুধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও এই সফল মিশনকে দুর্বল করতে চাইছে।’
মঙ্গলবার (২৪ জুন) সকালে ট্রাম্প হামলার ক্ষতি সম্পর্কে তার বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। মার্কিন পাইলটরা তাদের লক্ষ্যে আঘাত করেছে। লক্ষ্যগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, এবং পাইলটদের কৃতিত্ব দেওয়া উচিত।’
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুনর্নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে ট্রাম্প বলেন, ‘সেই জায়গাটা এখন পাথরের নিচে। সেটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।’
ট্রাম্প ও হেগসেথ হামলার সাফল্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকলেও, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান ড্যান কেইন রোববার (২২ জুন) বলেছিলেন যে, ক্ষতি মূল্যায়ন এখনো চলমান এবং ইরানের পরমাণু সক্ষমতা অবশিষ্ট আছে কিনা তা নিয়ে মন্তব্য করা ‘অত্যন্ত তাড়াহুড়ো’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান এমেরিটাস রিপাবলিকান প্রতিনিধি মাইকেল ম্যাককল মঙ্গলবার (২৪ জুন) সিএনএন-এর জিজ্ঞাসাবাদে ট্রাম্পের এই দাবির পুনরাবৃত্তি করতে অস্বীকার করেন যে, ইরানের কর্মসূচি ‘ধ্বংস’ হয়ে গেছে।
ম্যাককল সিএনএন-কে বলেন, ‘আমি অতীতে এই পরিকল্পনা নিয়ে ব্রিফিং পেয়েছি, এবং এটি কখনই পরমাণু সুবিধাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য তৈরি হয়নি, বরং উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করার জন্য।’
মিডলবারি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক জেফ্রি লুইস, যিনি হামলার স্থানের বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করেছেন, তিনি এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত যে হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শেষ হয়ে যায়নি।
লুইস বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি আসার আগে ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্র নাতানজ, ইসফাহান ও পারচিনের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূগর্ভস্থ পরমাণু সুবিধা ধ্বংস করতে পারেনি।’
তিনি যোগ করেন, ‘এই সুবিধাগুলো ইরানের পরমাণু কর্মসূচি দ্রুত পুনরুদ্ধারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।’
মঙ্গলবার (২৪ জুন) সকালে, এই অপারেশন নিয়ে হাউস ও সিনেটের জন্য নির্ধারিত গোপন ব্রিফিং বাতিল করা হয়েছে। এই বিষয়ে জানা দুই সূত্র বলেছেন, সমস্ত সিনেটরদের জন্য ব্রিফিং আগামী বৃহস্পতিবারে স্থগিত করা হয়েছে।
সিএনএন-কে জানা দুই পৃথক সূত্র বলেছেন, হোয়াইট হাউসের সকল আইনপ্রণেতাদের জন্যও ব্রিফিং পেছানো হয়েছে। এটি কেন স্থগিত করা হয়েছে বা কখন পুনরায় নির্ধারণ করা হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাটিক প্রতিনিধি প্যাট রায়ান মঙ্গলবার (২৪ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখেন, ‘ট্রাম্প কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ইরান হামলা নিয়ে একটি গোপন হাউস ব্রিফিং বাতিল করেছেন। আসল কারণ কি?
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসিভ অর্ডিনেন্স পেনেট্রেটর (এমওপি) বাঙ্কার বাস্টার বোমাগুলো ইরানের অত্যন্ত সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ পরমাণু স্থাপনা, বিশেষ করে ফোর্দো ও ইসফাহানে (ইরানের বৃহত্তম পরমাণু গবেষণা কমপ্লেক্স) সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন রয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা, ইরানের গোপন পরমাণু সুবিধা এখনো রয়েছে, যা হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল না এবং সেগুলো এখনও সক্রিয় রয়েছে।
সূত্র: সিএনএন